কাজল । তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাস পিডিএফ ডাউনলোড
ডিজিটাল বইয়ের নাম- কাজল
লেখক- তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
বইয়ের ধরন- উপন্যাস
ফাইলের ধরন- পিডিএফ
এই বইতে মোট পৃষ্টা আছে- ১২২
ডিজিটাল বইয়ের সাইজ- ৯ এমবি
প্রিন্ট ভালো, অবশ্যই জলছাপমুক্ত
ঐ মেসে ছিলেন উনি বহুদিন, কাগজপত্র বইখাতা জিনিসপত্র জমেছিল ওখানে অপর্যাপ্ত। মেসের বাস যখন তুলে দেন তখন তার কিছু জিনিস উনি পাঠিয়ে দেন ঘাটশীলায়, কিছু আমাদের দেশের বাড়ি গোপালনগর বারাকপুরে।
ঘাটশীলার যে ঘরে আমি শুতাম তার পায়ের দিকের দেওয়ালে টাঙানো ছিল ভারি সুন্দর একটি শিশুর ছবি, অপূর্ব ছবিটি। খয়েরী রংয়ের সঙ্গে সাদা মেশানো বিলিতি ছবি। নিচে ইংরেজীতে ছবিটির নাম লেখা ছিল—'বাবলস্'। ছেলেটির কোলের উপর একটি বাটিতে কিছু সাবানগোলা জল। একটি কাঠিতে ফুঁ দিয়ে ছেলেটি বুদবুদ তৈরি করছে।
ওঁর কাছে জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম, কোনও বিলাতী কোম্পানীর বিজ্ঞাপনের ক্যালেণ্ডার ওটা। উনি ছবিটি আমাকে দেখিয়ে বলেছিলেন ঐ ছবি দেখেই নাকি উনি কাজলের চরিত্র কল্পনা করেছিলেন। অমনি নিস্পাপ, দেবদুর্লভ রূপবান, কোমল, সুন্দর ছেলেটি কাজল নাকি ওঁর কল্পনায় ঐ রূপেই ছিল।
উনি নিজে আমাকে বহুদিন বলেছেন, একসময়ে নাকি উনি সন্তান-সন্তান করে ক্ষেপে গিয়েছিলেন। বহু লোকের কাছে শুনেছি, অনেককে উনি নাকি বলতেন—আমাকে বাবা ডাকবি?-ডাক না।
আরও শুনেছি, এই পিতৃ-সম্বোধন শুনবার জন্য নানাপ্রকার ঘুষও দিতেন কাউকে কাউকে।
আজ আরও অনেক কথাই মনে পড়ছে। ওঁর ধর্মমেয়ে, নাম তার রেণু। রেণুর উল্লেখ আছে ওর অনেক বইতে, ওঁর দিনপঞ্জিগুলিতে। ওঁর 'বিচিত্র জগৎ' বইখানা রেণুকে উৎসর্গ করেছিলেন। রেণুর সঙ্গে ওঁর স্নেহের সম্পর্ক গভীর ছিল। রেণুকে নিয়েই ওদের পরিবারের সঙ্গে ওঁর গভীর প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পরবর্তী কালে ওদের সকলের সঙ্গেই ওঁর আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় হয়েছিল।
আমার বিয়ের পরে রেণু এসে আমার সঙ্গে দেখা করে গেছে।
রেণু আমাকে ডাকত মা-মণি বলে, ওকে বলত বাবা। রেণুর সঙ্গে ওঁর মাঝে মাঝে দেখা হত কলকাতায়। রেণু তখন কলকাতাতেই ছিল।
বাবলু যখন একবছরের, সে সময় একদিন একটি নিরেট লোহার সুন্দর মোটরগাড়ি এনে বাবলুকে দেন। উনি বলেন, তোর দিদি দিয়েছে-রেণুদিদি।
কাজল সম্বন্ধে উনি কী লিখবেন, তার কিছু কিছু আভাস অপরাজিত বইতে পাওয়া যায়। ওতেই বীজাকারে কাজল সম্বন্ধে সকল কথাই প্রায় বলা আছে। তারপর যে তার কল্পনার কাজলকে বাস্তবে রূপ দেবে, প্রতিমার কাঠামোর ওপর খড়-বিচালি বেঁধে মাটি ধরিয়ে রং-তুলির স্পর্শে সেই প্রতিমাকে সঞ্জীবিত করবে সে দায়িত্ব তার। গল্পকে টেনে নিয়ে যাবার, উপন্যাসকে এগিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব লেখকের, বিভূতিভূষণের অসমাপ্ত রচনা যে সমাপ্ত করবে তার। তিনি জানতেন না ভবিষ্যতে এই কাজ করবে তারই পুত্র।
কাজল উপন্যাস সম্পর্কে কত নিভৃত মধ্যাহ্নে আকাশের নব নব ছায়ারূপ দেখতে দেখতে, সন্ধ্যাবেলায় বিলবিলের ধারে ঠেসদেয়ালে হেলান দিয়ে বিশ্রাম করতে করতে আলোচনা করেছেন। কাজল এখন কত বড় হয়েছে, কী করছে, কী ভাবছে, এসব আলোচনা করতেন। বাবলু তারাদাস হওয়ার পরে মুহূর্তে মুহূর্তে বাবলুকে দেখা চাই। বাবলু কী করছে, কেমন অঙ্গভঙ্গি করছে—সর্বদা বাড়ির সকলকে ডেকে দেখাতে ভালবাসতেন। সর্দার খেলুড়ের সঙ্গে বাবলু যেন ছিল শিশু-খেলুড়ে। বুঝতে পারতাম, কাজল উপন্যাসের পরিকল্পনা মাথায় ঘুরছে। কাজল উপন্যাস সম্বন্ধে বহু নোট নিতেন। কিছু কিছু লিখেও ছিলেন। ওঁর আকস্মিক মৃত্যুর জন্য, এবং এই উনিশ-কুড়ি বছরের ব্যবধানে বিশেষ কিছু রক্ষা করতে পারি নি। বাবলু যখন একটু বড় হল এবং স্কুলে যেতে শুরু করল, তখন সে বাবার কথা শুনতে চাইত। তার লেখার বিষয়, তার ভালোলাগা, তার জীবনচর্চা ও জানতে চাইত। তন্ময় হয়ে শুনত এবং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইত সব কিছু। দীর্ঘদিন বাবলুর সঙ্গে ওঁর স্মৃতিতর্পণ করতে করতে 'কাজল’ উপন্যাস সম্পর্কে খুঁটিনাটি আলোচনা করেছি। বাবলুর তখন থেকেই আগ্রহ ছিল 'কাজল’ লিখবার। অন্তরে অন্তরে গভীর ইচ্ছা ছিল। তার হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষার পরে একেবারে একটানা অবসর, সে অবসর কী করে কাটবে এই ভাবনায় যখন অস্থির হয়ে উঠেছিল, তখন নিজেই একদিন আমায় বলল—মা, 'কাজল' লিখতে শুরু করি। তুমি কী বল? আমি সেদিন ওকে মুখে উৎসাহ দিয়েছিলাম, বলেছিলাম, লেখ, চেষ্টা কর। চেষ্টার অসাধ্য কী আছে।
সেই শুরু, তারপর তিনবছর পার হয়ে চারবছর চলছে। আজ কাজল সত্যিই শেষ হল।
আমার শ্বশুরমশাই-এর অসমাপ্ত কার্যভার তুলে নিয়েছিলেন তার পুত্র অসীম শ্রদ্ধার সঙ্গে। আজ তাদের পায়ের তলায়, বঙ্গবাণীর পায়ের তলায় বাবলু কুণ্ঠিত অক্ষম পদক্ষেপে পূজার থালা নিয়ে দাঁড়াল। সামান্য উপচার, অতিসামান্য ওর পুঁজি। কিন্তু পূজায় যার যেটুকু ক্ষমতা সে তাই নিয়েই সাঙ্গ করে, এও তাই। তার নির্মল পূজার আগ্রহটুকুই ভগবান গ্রহণ করুন।
১৩৫৭ সালের ২৮শে ভাদ্র ওঁর জীবিতাবস্থায় শেষ জন্মদিনের অনুষ্ঠান হয়েছিল আমার মামার বাসাবাড়ি সুইনহো স্ট্রীটে। এই অনুষ্ঠানে বহু সাহিত্যিক বন্ধুরা এসেছিলেন ওঁর। শ্রদ্ধেয় উপেন-দা, বন্ধুবর মনোজ বসু, ডাঃ নলিনাক্ষ সান্যাল, বেগম জাহান-আরা খান স্বামী সহ, গজেন ঠাকুরপো, সুমথ ঠাকুরপো ইত্যাদি। এই জন্মদিনে গজেন ঠাকুরপোরা ওঁকে একখানা খাতা উপহার দেন তার ওপর একটি কালো কভার লাগানো ছিল। সুন্দর করে বাঁধানো, তাতে সোনালী অক্ষরে ইংরাজীতে লেখা ছিল—কাজল। এ খাতাখানা আজও আমার কাছে আছে। সেই সময়েই ঠিক হয়ে যায়, কাজল উনি লিখতে শুরু করবেন অবিলম্বে এবং তা ধারাবাহিকভাবে বেরুবে কোন পত্রিকায়। আমি জানতাম 'কাজল’ উনি লিখবেন, যেমন জানতাম 'ইছামতী' উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড উনি লিখবেন। অথৈ জলও দ্বিতীয় খণ্ড লিখবার ইচ্ছে ছিল ওর। ওঁরই কাছে আরও শুনেছি ওঁর ‘দেবযান' লিখবার ইচ্ছা ছিল পথের পাঁচালী লিখবারও আগে। কিন্তু লিখেছেন অনেক পরে। একটা খাতায় উনি দেবযানের খানিকটা লিখে রেখেছিলেন বহুদিন পর্যন্ত। এ লেখার বহু পরে উনি ‘দেবযান' শেষ করেন—আমার বিয়েরও দু-তিন বছর পরে। তখন দেবযানের নাম ছিল দেবতার ব্যথা। ওর রচনার প্লট লেখা থাকত ছোট ছোট বইতে। তাতে উনি কী লিখবেন সামান্য কথায় তার স্কেচ করে রাখতেন। পরে ঐ স্কেচ দেখলেই ওর মনে পড়ত উনি কী লিখবেন। ঐ সব বিভিন্ন চরিত্রের বহু ঘটনার সামান্য টুকরো ও নানান লেখার খসড়া আজও আমি রেখে দিয়েছি যত্ন করে আমার কাছে। তাকে কত কী লিখবার, কত কী জানবার আগ্রহ ছিল ওঁর, তার পরিচয় পাওয়া যায়। আরও পাওয়া যায়, কত কী পড়েছিলেন উনি তার আভাস। উনি যেন ছিলেন চিরদিনের ছাত্র—প্রকৃতির এই মহিমময় অনন্ত ঐশ্বর্যভরা পরিবেশ, এর ভিতরে আত্মহারা ছিলেন তিনি। প্রকৃতিপাগল বিভূতিভূষণ। ঘাটশীলায় ওঁর মৃত্যুর পাঁচ-ছ দিন আগে বেলাশেষে আমি বসেছিলাম আমাদের বারান্দার চওড়া সিঁড়ির ওপর। উনি দাঁড়িয়ে ছিলেন সামনে। বাবলু উঠোনের ঘাসের ওপর ওর বাবাকে নিয়ে খেলছিল। আজও বড় বেশি করে সেই দিনটির কথা, সেই অপরাহ্ন বেলাটির কথা আমার মনে পড়ে।
উনি সে সময়ে আমাকে বললেন—তুমি আমার দিকে একদম নজর দাও না। আমি কখন কী করি বল তো? এদিকে আমার 'কাজল’ শুরু করতে হবে। বাবলুকে নিয়ে কী যে করি! তুমি শুধু শুধু বাবলুকে আমার কাছে দাও।
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। সে কী গো, আমিই বরং ছেলেটাকে কাছে পাই নে, শুধু তুমি ওকে নিয়ে ঘুরছ কোথায় কোথায়। ওর দুর্বল স্বাস্থ্য-কোথায় আমি ভাবছি, ওর কী স্বাস্থ্য টিকবে!
চট করে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন উনি। আর বেড়ানো নয়, কী বল? খুবই বেড়ানো হয়েছে। পুজোর ভেতর অত্যন্ত বেড়ালাম, কী বল? বেড়ালাম না?
আমি চুপ করে রইলাম। এমন ভ্রমণ-বাতিকগ্রস্ত লোক আমি জীবনে দেখিনি। ছেলেপুলেদের যেমন মিষ্টি ও খেলনার লোভ দেখিয়ে বশীভূত করা যায়, এই বালকস্বভাব ভদ্রলোকটিকে বেড়ানোর নামে যেখানে যেখানে নিয়ে যাওয়া যেত, যদি জানতে পারতেন সেখানে দেখবার কিছু আছে।
উনি নিজেই আবার বললেন—এইবার লেখা শুরু করি, কী বল? পূজোতে ওরকম সবাই একটু বুঝলে না?' সব বন্ধুবান্ধব এক জায়গায় হওয়া, আমোদ হয় না? কী বল? কাল আমাকে খুব ভোরে তুলে দেবে, বুঝলে? আমি হাসলাম। তোমার চাইতে ভোরে উঠব আমি? তোমার চোখে কী ঘুম আছে? আমার তো মনে হয় না।
ঔরই ডাকে ঘুম ভাঙল সেদিন আমার—ওঠো, ওঠো। গেট খুলে দাও। আমি কাজলের ছক তৈরি করব না আজ? মনে নেই? ওঠো, দেরি হয়ে যাবে।
আমি ঘুম-জড়ানো চোখে বাইরের দিকে তাকালাম।-রাত রয়েছে যে, আর একটু পরে যাও। যাবে বনে পাহাড়ে, ওখানে তো সদাই নির্জন।
উনি বললেন—না, উপাসনা সেরে নেব না আমার সেই শিলাসনে? তারপরে লেখা।
আমি জানতাম, উনি 'ফুলডুংরী’র পেছনে বনের ভেতর একটি বিরাট পাথরের ওপর বসে লিখতেন। আমাকেও নিয়ে যেতেন ওখানে মাঝে মাঝে, উপাসনা করতেন। সে সব কত কথা, কত স্মৃতি। | তখনও জানি না, কী করাল মেঘ ঝুলছে আমার মাথার ওপর—গর্ভে তার বজ্রগ্নি লুকিয়ে নিয়ে। সেইদিনই যে আমার জীবনের চরম দিন, তার কিছুমাত্র আভাস পাইনি আমি।
সকাল সকাল ফেরা ওঁর হল না। উনি ফিরলেন একেবারে বেলা সাড়ে-দশটা এগারোটায়। আমি তখন রান্নায় ব্যস্ত। ওঁকে দোর খুলে দিলাম। উনি বললেন—প্রচণ্ড ক্ষিদে পেয়েছে আমার।
ওঁর খাবার করাই ছিল। বিছানার উপর বসলে ওঁকে খাবার এনে দিলাম। উনি সেই খাবারটুকু খেয়ে আমাকে বললেন—আরও কিছু দাও। কী আছে তোমার ? আমি বললাম—নারকেল-চিড়ে খাও। তুমি ভালবাস। নারকেল-চিড়ে দিয়ে আমি আবার রান্নায় ফিরে গেলাম। একটু বাদে ওঁর ডাক আবার কানে গেল—শুনে যাও। আমি রান্নাঘর থেকে ছুটে গেলাম ওঁর কাছে।
এমন করে তো উনি ডাকেন না আমাকে। আমি যেতেই উনি বললেন-দেখ, আমার বুকে যেন চিড়ে আটকে গেছে।
আমি বললাম, শুকননা চিড়ে খেলে এমনিই হয়। ভিজিয়ে খেতে চাও না আম কলা না থাকলে। কত ঘুরে এসেহ, গলা শুকিয়ে আছে না? আমি ওঁর গলায় বুকে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম।
উনি বললেন, একটু কোরামিন দাও আমাকে। আমার ঘরে কোরামিন থাকত। আমার দেওর নুটুবিহারী ডাক্তার ছিলেন। আমি ওঁকে ধরে আছি—আমার জা যমুনাকে ডেকে বললাম—দশ ফোটা কোরামিন দে তো।
আমি জীবনে ওঁকে খুব সামান্যই ওষুধ খেতে দেখেছি। কোরামিন চাওয়ায় আমি ঘাবড়ে গেলাম খুব। সেই সূচনা। তখন বুঝিনি আমি। স্বাস্থ্যবান লোক ছিলেন। একটু পরেই সামলে উঠলেন কিছুটা। আমিও তখন অনভিজ্ঞা। বুঝতে পারিনি কী কঠোর নিয়তি অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
উনি স্নান করতে যাবেন বললেন। বাড়িতে স্নান করতেন না কখনও। দেশে থাকলে নদীতে, ঘাটশীলায় নানা পুকুরে। আমাকেও মাঝে মাঝে নিয়ে যেতেন সঙ্গে করে। ইদানীং বাবলুকে নিয়ে যেতেন রোজ—আমি না গেলেও।
সেদিন বললেন—আজ আর বাবলুকে নেব না, শরীরটা ভাল নেই।
অনেক বাধা দিলাম। শরীর ভাল নেই, বাইরে স্নান করতে যেও না তুমি।
কিছুতেই শুনলেন না।
আমি বললাম-উঠোনের ধারে জল দিই তোমায়। বাথরুমে নাই বা নাইলে। বাথরুমে স্নান করতে একদম ভালবাসতেন না উনি। আমাদের ঘরের সামনের চওড়া সিঁড়িগুলিতে বসে স্নান করতে বলেছিলাম আমি।
উনি বললেন—কিছু হবে না। যাব আর আসব। তখন কিছু হল না।
দুপুরে ভাত খেতে বসেছেন, তখন ধলভূমগড় রাজবাড়ি থেকে নিমন্ত্রণ করে গেল টি-পার্টির। উনি খুশী হয়ে বললেন—যাব ঠিক, বঙ্কিমবাবুকে গিয়ে বল। দু-একজন কাকে আরও নিমন্ত্রণ করতে বললেন। তখনও জানি না, কী আছে আমাদের কপালে।
একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। ঠাকুরপোর ডাকে ঘুম ভাঙল—দাদা কী সাজে যাচ্ছে উঠে দেখ বৌদি।
আমার দুরন্ত অভিমান হল। আমার কী একটুও ইচ্ছে করে না উনি একটু সাজুন?
আমি চুপ করে রইলাম। উনি হয়তো বুঝলেন আমার অন্তরের অভিমান। তাই বললেন—দাও কী দেবে। কী হবে সাজলে-গুজলে ? দুখানা হাত বেরুবে আমার?
সেইদিন—আর তারপর তিনদিনের দিন ওকে মহাযাত্রায় সাজিয়ে দিয়েছিলাম।
আপনাদের আশীর্বাদে বাবলু 'কাজল’ লিখেছে। আজ সকলের সঙ্গে ওঁর আশীর্বাদও বাবলুর মাথায় ঝরে পড়ুক।
বাণভট্টের পুত্র ভূষণভট্ট অসমাপ্ত 'কাদম্বরী’ শেষ করেছিলেন। বাবলুর হাতে বিভূতিভূষণ পরিকল্পিত 'কাজল’ প্রাণময় হয়ে উঠুক এই আমার মঙ্গলময়ের প্রতি প্রার্থনা। -রমা বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রিয় পাঠকগণ, আপনারা আরো সংগ্রহ করতে পারেন-
অপুর সংসার সমগ্র- বিভূতিভূষণ ও তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
উপরোক্ত বাংলা বইটির পিডিএফ ফাইল সংগ্রহ করুন অথবা অনলাইনে পড়ুন
পঠকগণ, অপু ট্রিলজির শেষ বই 'কাজল'-এর বাংলা বই পিডিএফ সংগ্রহ করতে পারবেন। প্রকৃতিপ্রেমী লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উপন্যাসটি লেখার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সেটি লেখারতার আগেই তিনি মারা যান, এর পরেই বিভূতিভূষণের সুযোগ্য পুত্র তারাদাস এই অসাধারণ উপন্যাস লিখে পিতার সেই শেষ ইচ্ছা সম্পূর্ণ করেন।
ডিজিটাল বইয়ের নাম- কাজল
লেখক- তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
বইয়ের ধরন- উপন্যাস
ফাইলের ধরন- পিডিএফ
এই বইতে মোট পৃষ্টা আছে- ১২২
ডিজিটাল বইয়ের সাইজ- ৯ এমবি
প্রিন্ট ভালো, অবশ্যই জলছাপমুক্ত
বিভূতিভূষণ ও কাজলের পশ্চাৎপট।
১৯৪০ সনের ৩রা ডিসেম্বর আমার বিয়ে হয়। সে সময়ে উনি ৪১ নম্বর মির্জাপুর স্ত্রীটের ‘প্যারাডাইস লজে’ থাকতেন। আমার বিয়ের প্রায় একবছর পরে ঐ মেসের বাস তিনি উঠিয়ে দেন।ঐ মেসে ছিলেন উনি বহুদিন, কাগজপত্র বইখাতা জিনিসপত্র জমেছিল ওখানে অপর্যাপ্ত। মেসের বাস যখন তুলে দেন তখন তার কিছু জিনিস উনি পাঠিয়ে দেন ঘাটশীলায়, কিছু আমাদের দেশের বাড়ি গোপালনগর বারাকপুরে।
ঘাটশীলার যে ঘরে আমি শুতাম তার পায়ের দিকের দেওয়ালে টাঙানো ছিল ভারি সুন্দর একটি শিশুর ছবি, অপূর্ব ছবিটি। খয়েরী রংয়ের সঙ্গে সাদা মেশানো বিলিতি ছবি। নিচে ইংরেজীতে ছবিটির নাম লেখা ছিল—'বাবলস্'। ছেলেটির কোলের উপর একটি বাটিতে কিছু সাবানগোলা জল। একটি কাঠিতে ফুঁ দিয়ে ছেলেটি বুদবুদ তৈরি করছে।
ওঁর কাছে জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম, কোনও বিলাতী কোম্পানীর বিজ্ঞাপনের ক্যালেণ্ডার ওটা। উনি ছবিটি আমাকে দেখিয়ে বলেছিলেন ঐ ছবি দেখেই নাকি উনি কাজলের চরিত্র কল্পনা করেছিলেন। অমনি নিস্পাপ, দেবদুর্লভ রূপবান, কোমল, সুন্দর ছেলেটি কাজল নাকি ওঁর কল্পনায় ঐ রূপেই ছিল।
উনি নিজে আমাকে বহুদিন বলেছেন, একসময়ে নাকি উনি সন্তান-সন্তান করে ক্ষেপে গিয়েছিলেন। বহু লোকের কাছে শুনেছি, অনেককে উনি নাকি বলতেন—আমাকে বাবা ডাকবি?-ডাক না।
আরও শুনেছি, এই পিতৃ-সম্বোধন শুনবার জন্য নানাপ্রকার ঘুষও দিতেন কাউকে কাউকে।
আজ আরও অনেক কথাই মনে পড়ছে। ওঁর ধর্মমেয়ে, নাম তার রেণু। রেণুর উল্লেখ আছে ওর অনেক বইতে, ওঁর দিনপঞ্জিগুলিতে। ওঁর 'বিচিত্র জগৎ' বইখানা রেণুকে উৎসর্গ করেছিলেন। রেণুর সঙ্গে ওঁর স্নেহের সম্পর্ক গভীর ছিল। রেণুকে নিয়েই ওদের পরিবারের সঙ্গে ওঁর গভীর প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। পরবর্তী কালে ওদের সকলের সঙ্গেই ওঁর আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় হয়েছিল।
আমার বিয়ের পরে রেণু এসে আমার সঙ্গে দেখা করে গেছে।
রেণু আমাকে ডাকত মা-মণি বলে, ওকে বলত বাবা। রেণুর সঙ্গে ওঁর মাঝে মাঝে দেখা হত কলকাতায়। রেণু তখন কলকাতাতেই ছিল।
বাবলু যখন একবছরের, সে সময় একদিন একটি নিরেট লোহার সুন্দর মোটরগাড়ি এনে বাবলুকে দেন। উনি বলেন, তোর দিদি দিয়েছে-রেণুদিদি।
কাজল সম্বন্ধে উনি কী লিখবেন, তার কিছু কিছু আভাস অপরাজিত বইতে পাওয়া যায়। ওতেই বীজাকারে কাজল সম্বন্ধে সকল কথাই প্রায় বলা আছে। তারপর যে তার কল্পনার কাজলকে বাস্তবে রূপ দেবে, প্রতিমার কাঠামোর ওপর খড়-বিচালি বেঁধে মাটি ধরিয়ে রং-তুলির স্পর্শে সেই প্রতিমাকে সঞ্জীবিত করবে সে দায়িত্ব তার। গল্পকে টেনে নিয়ে যাবার, উপন্যাসকে এগিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব লেখকের, বিভূতিভূষণের অসমাপ্ত রচনা যে সমাপ্ত করবে তার। তিনি জানতেন না ভবিষ্যতে এই কাজ করবে তারই পুত্র।
কাজল উপন্যাস সম্পর্কে কত নিভৃত মধ্যাহ্নে আকাশের নব নব ছায়ারূপ দেখতে দেখতে, সন্ধ্যাবেলায় বিলবিলের ধারে ঠেসদেয়ালে হেলান দিয়ে বিশ্রাম করতে করতে আলোচনা করেছেন। কাজল এখন কত বড় হয়েছে, কী করছে, কী ভাবছে, এসব আলোচনা করতেন। বাবলু তারাদাস হওয়ার পরে মুহূর্তে মুহূর্তে বাবলুকে দেখা চাই। বাবলু কী করছে, কেমন অঙ্গভঙ্গি করছে—সর্বদা বাড়ির সকলকে ডেকে দেখাতে ভালবাসতেন। সর্দার খেলুড়ের সঙ্গে বাবলু যেন ছিল শিশু-খেলুড়ে। বুঝতে পারতাম, কাজল উপন্যাসের পরিকল্পনা মাথায় ঘুরছে। কাজল উপন্যাস সম্বন্ধে বহু নোট নিতেন। কিছু কিছু লিখেও ছিলেন। ওঁর আকস্মিক মৃত্যুর জন্য, এবং এই উনিশ-কুড়ি বছরের ব্যবধানে বিশেষ কিছু রক্ষা করতে পারি নি। বাবলু যখন একটু বড় হল এবং স্কুলে যেতে শুরু করল, তখন সে বাবার কথা শুনতে চাইত। তার লেখার বিষয়, তার ভালোলাগা, তার জীবনচর্চা ও জানতে চাইত। তন্ময় হয়ে শুনত এবং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইত সব কিছু। দীর্ঘদিন বাবলুর সঙ্গে ওঁর স্মৃতিতর্পণ করতে করতে 'কাজল’ উপন্যাস সম্পর্কে খুঁটিনাটি আলোচনা করেছি। বাবলুর তখন থেকেই আগ্রহ ছিল 'কাজল’ লিখবার। অন্তরে অন্তরে গভীর ইচ্ছা ছিল। তার হায়ার সেকেণ্ডারী পরীক্ষার পরে একেবারে একটানা অবসর, সে অবসর কী করে কাটবে এই ভাবনায় যখন অস্থির হয়ে উঠেছিল, তখন নিজেই একদিন আমায় বলল—মা, 'কাজল' লিখতে শুরু করি। তুমি কী বল? আমি সেদিন ওকে মুখে উৎসাহ দিয়েছিলাম, বলেছিলাম, লেখ, চেষ্টা কর। চেষ্টার অসাধ্য কী আছে।
সেই শুরু, তারপর তিনবছর পার হয়ে চারবছর চলছে। আজ কাজল সত্যিই শেষ হল।
আমার শ্বশুরমশাই-এর অসমাপ্ত কার্যভার তুলে নিয়েছিলেন তার পুত্র অসীম শ্রদ্ধার সঙ্গে। আজ তাদের পায়ের তলায়, বঙ্গবাণীর পায়ের তলায় বাবলু কুণ্ঠিত অক্ষম পদক্ষেপে পূজার থালা নিয়ে দাঁড়াল। সামান্য উপচার, অতিসামান্য ওর পুঁজি। কিন্তু পূজায় যার যেটুকু ক্ষমতা সে তাই নিয়েই সাঙ্গ করে, এও তাই। তার নির্মল পূজার আগ্রহটুকুই ভগবান গ্রহণ করুন।
১৩৫৭ সালের ২৮শে ভাদ্র ওঁর জীবিতাবস্থায় শেষ জন্মদিনের অনুষ্ঠান হয়েছিল আমার মামার বাসাবাড়ি সুইনহো স্ট্রীটে। এই অনুষ্ঠানে বহু সাহিত্যিক বন্ধুরা এসেছিলেন ওঁর। শ্রদ্ধেয় উপেন-দা, বন্ধুবর মনোজ বসু, ডাঃ নলিনাক্ষ সান্যাল, বেগম জাহান-আরা খান স্বামী সহ, গজেন ঠাকুরপো, সুমথ ঠাকুরপো ইত্যাদি। এই জন্মদিনে গজেন ঠাকুরপোরা ওঁকে একখানা খাতা উপহার দেন তার ওপর একটি কালো কভার লাগানো ছিল। সুন্দর করে বাঁধানো, তাতে সোনালী অক্ষরে ইংরাজীতে লেখা ছিল—কাজল। এ খাতাখানা আজও আমার কাছে আছে। সেই সময়েই ঠিক হয়ে যায়, কাজল উনি লিখতে শুরু করবেন অবিলম্বে এবং তা ধারাবাহিকভাবে বেরুবে কোন পত্রিকায়। আমি জানতাম 'কাজল’ উনি লিখবেন, যেমন জানতাম 'ইছামতী' উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড উনি লিখবেন। অথৈ জলও দ্বিতীয় খণ্ড লিখবার ইচ্ছে ছিল ওর। ওঁরই কাছে আরও শুনেছি ওঁর ‘দেবযান' লিখবার ইচ্ছা ছিল পথের পাঁচালী লিখবারও আগে। কিন্তু লিখেছেন অনেক পরে। একটা খাতায় উনি দেবযানের খানিকটা লিখে রেখেছিলেন বহুদিন পর্যন্ত। এ লেখার বহু পরে উনি ‘দেবযান' শেষ করেন—আমার বিয়েরও দু-তিন বছর পরে। তখন দেবযানের নাম ছিল দেবতার ব্যথা। ওর রচনার প্লট লেখা থাকত ছোট ছোট বইতে। তাতে উনি কী লিখবেন সামান্য কথায় তার স্কেচ করে রাখতেন। পরে ঐ স্কেচ দেখলেই ওর মনে পড়ত উনি কী লিখবেন। ঐ সব বিভিন্ন চরিত্রের বহু ঘটনার সামান্য টুকরো ও নানান লেখার খসড়া আজও আমি রেখে দিয়েছি যত্ন করে আমার কাছে। তাকে কত কী লিখবার, কত কী জানবার আগ্রহ ছিল ওঁর, তার পরিচয় পাওয়া যায়। আরও পাওয়া যায়, কত কী পড়েছিলেন উনি তার আভাস। উনি যেন ছিলেন চিরদিনের ছাত্র—প্রকৃতির এই মহিমময় অনন্ত ঐশ্বর্যভরা পরিবেশ, এর ভিতরে আত্মহারা ছিলেন তিনি। প্রকৃতিপাগল বিভূতিভূষণ। ঘাটশীলায় ওঁর মৃত্যুর পাঁচ-ছ দিন আগে বেলাশেষে আমি বসেছিলাম আমাদের বারান্দার চওড়া সিঁড়ির ওপর। উনি দাঁড়িয়ে ছিলেন সামনে। বাবলু উঠোনের ঘাসের ওপর ওর বাবাকে নিয়ে খেলছিল। আজও বড় বেশি করে সেই দিনটির কথা, সেই অপরাহ্ন বেলাটির কথা আমার মনে পড়ে।
উনি সে সময়ে আমাকে বললেন—তুমি আমার দিকে একদম নজর দাও না। আমি কখন কী করি বল তো? এদিকে আমার 'কাজল’ শুরু করতে হবে। বাবলুকে নিয়ে কী যে করি! তুমি শুধু শুধু বাবলুকে আমার কাছে দাও।
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। সে কী গো, আমিই বরং ছেলেটাকে কাছে পাই নে, শুধু তুমি ওকে নিয়ে ঘুরছ কোথায় কোথায়। ওর দুর্বল স্বাস্থ্য-কোথায় আমি ভাবছি, ওর কী স্বাস্থ্য টিকবে!
চট করে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন উনি। আর বেড়ানো নয়, কী বল? খুবই বেড়ানো হয়েছে। পুজোর ভেতর অত্যন্ত বেড়ালাম, কী বল? বেড়ালাম না?
আমি চুপ করে রইলাম। এমন ভ্রমণ-বাতিকগ্রস্ত লোক আমি জীবনে দেখিনি। ছেলেপুলেদের যেমন মিষ্টি ও খেলনার লোভ দেখিয়ে বশীভূত করা যায়, এই বালকস্বভাব ভদ্রলোকটিকে বেড়ানোর নামে যেখানে যেখানে নিয়ে যাওয়া যেত, যদি জানতে পারতেন সেখানে দেখবার কিছু আছে।
উনি নিজেই আবার বললেন—এইবার লেখা শুরু করি, কী বল? পূজোতে ওরকম সবাই একটু বুঝলে না?' সব বন্ধুবান্ধব এক জায়গায় হওয়া, আমোদ হয় না? কী বল? কাল আমাকে খুব ভোরে তুলে দেবে, বুঝলে? আমি হাসলাম। তোমার চাইতে ভোরে উঠব আমি? তোমার চোখে কী ঘুম আছে? আমার তো মনে হয় না।
ঔরই ডাকে ঘুম ভাঙল সেদিন আমার—ওঠো, ওঠো। গেট খুলে দাও। আমি কাজলের ছক তৈরি করব না আজ? মনে নেই? ওঠো, দেরি হয়ে যাবে।
আমি ঘুম-জড়ানো চোখে বাইরের দিকে তাকালাম।-রাত রয়েছে যে, আর একটু পরে যাও। যাবে বনে পাহাড়ে, ওখানে তো সদাই নির্জন।
উনি বললেন—না, উপাসনা সেরে নেব না আমার সেই শিলাসনে? তারপরে লেখা।
আমি জানতাম, উনি 'ফুলডুংরী’র পেছনে বনের ভেতর একটি বিরাট পাথরের ওপর বসে লিখতেন। আমাকেও নিয়ে যেতেন ওখানে মাঝে মাঝে, উপাসনা করতেন। সে সব কত কথা, কত স্মৃতি। | তখনও জানি না, কী করাল মেঘ ঝুলছে আমার মাথার ওপর—গর্ভে তার বজ্রগ্নি লুকিয়ে নিয়ে। সেইদিনই যে আমার জীবনের চরম দিন, তার কিছুমাত্র আভাস পাইনি আমি।
সকাল সকাল ফেরা ওঁর হল না। উনি ফিরলেন একেবারে বেলা সাড়ে-দশটা এগারোটায়। আমি তখন রান্নায় ব্যস্ত। ওঁকে দোর খুলে দিলাম। উনি বললেন—প্রচণ্ড ক্ষিদে পেয়েছে আমার।
ওঁর খাবার করাই ছিল। বিছানার উপর বসলে ওঁকে খাবার এনে দিলাম। উনি সেই খাবারটুকু খেয়ে আমাকে বললেন—আরও কিছু দাও। কী আছে তোমার ? আমি বললাম—নারকেল-চিড়ে খাও। তুমি ভালবাস। নারকেল-চিড়ে দিয়ে আমি আবার রান্নায় ফিরে গেলাম। একটু বাদে ওঁর ডাক আবার কানে গেল—শুনে যাও। আমি রান্নাঘর থেকে ছুটে গেলাম ওঁর কাছে।
এমন করে তো উনি ডাকেন না আমাকে। আমি যেতেই উনি বললেন-দেখ, আমার বুকে যেন চিড়ে আটকে গেছে।
আমি বললাম, শুকননা চিড়ে খেলে এমনিই হয়। ভিজিয়ে খেতে চাও না আম কলা না থাকলে। কত ঘুরে এসেহ, গলা শুকিয়ে আছে না? আমি ওঁর গলায় বুকে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম।
উনি বললেন, একটু কোরামিন দাও আমাকে। আমার ঘরে কোরামিন থাকত। আমার দেওর নুটুবিহারী ডাক্তার ছিলেন। আমি ওঁকে ধরে আছি—আমার জা যমুনাকে ডেকে বললাম—দশ ফোটা কোরামিন দে তো।
আমি জীবনে ওঁকে খুব সামান্যই ওষুধ খেতে দেখেছি। কোরামিন চাওয়ায় আমি ঘাবড়ে গেলাম খুব। সেই সূচনা। তখন বুঝিনি আমি। স্বাস্থ্যবান লোক ছিলেন। একটু পরেই সামলে উঠলেন কিছুটা। আমিও তখন অনভিজ্ঞা। বুঝতে পারিনি কী কঠোর নিয়তি অপেক্ষা করছে আমার জন্য।
উনি স্নান করতে যাবেন বললেন। বাড়িতে স্নান করতেন না কখনও। দেশে থাকলে নদীতে, ঘাটশীলায় নানা পুকুরে। আমাকেও মাঝে মাঝে নিয়ে যেতেন সঙ্গে করে। ইদানীং বাবলুকে নিয়ে যেতেন রোজ—আমি না গেলেও।
সেদিন বললেন—আজ আর বাবলুকে নেব না, শরীরটা ভাল নেই।
অনেক বাধা দিলাম। শরীর ভাল নেই, বাইরে স্নান করতে যেও না তুমি।
কিছুতেই শুনলেন না।
আমি বললাম-উঠোনের ধারে জল দিই তোমায়। বাথরুমে নাই বা নাইলে। বাথরুমে স্নান করতে একদম ভালবাসতেন না উনি। আমাদের ঘরের সামনের চওড়া সিঁড়িগুলিতে বসে স্নান করতে বলেছিলাম আমি।
উনি বললেন—কিছু হবে না। যাব আর আসব। তখন কিছু হল না।
দুপুরে ভাত খেতে বসেছেন, তখন ধলভূমগড় রাজবাড়ি থেকে নিমন্ত্রণ করে গেল টি-পার্টির। উনি খুশী হয়ে বললেন—যাব ঠিক, বঙ্কিমবাবুকে গিয়ে বল। দু-একজন কাকে আরও নিমন্ত্রণ করতে বললেন। তখনও জানি না, কী আছে আমাদের কপালে।
একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। ঠাকুরপোর ডাকে ঘুম ভাঙল—দাদা কী সাজে যাচ্ছে উঠে দেখ বৌদি।
আমার দুরন্ত অভিমান হল। আমার কী একটুও ইচ্ছে করে না উনি একটু সাজুন?
আমি চুপ করে রইলাম। উনি হয়তো বুঝলেন আমার অন্তরের অভিমান। তাই বললেন—দাও কী দেবে। কী হবে সাজলে-গুজলে ? দুখানা হাত বেরুবে আমার?
সেইদিন—আর তারপর তিনদিনের দিন ওকে মহাযাত্রায় সাজিয়ে দিয়েছিলাম।
আপনাদের আশীর্বাদে বাবলু 'কাজল’ লিখেছে। আজ সকলের সঙ্গে ওঁর আশীর্বাদও বাবলুর মাথায় ঝরে পড়ুক।
বাণভট্টের পুত্র ভূষণভট্ট অসমাপ্ত 'কাদম্বরী’ শেষ করেছিলেন। বাবলুর হাতে বিভূতিভূষণ পরিকল্পিত 'কাজল’ প্রাণময় হয়ে উঠুক এই আমার মঙ্গলময়ের প্রতি প্রার্থনা। -রমা বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রিয় পাঠকগণ, আপনারা আরো সংগ্রহ করতে পারেন-
অপুর সংসার সমগ্র- বিভূতিভূষণ ও তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
কাজল।তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় |
পঠকগণ, অপু ট্রিলজির শেষ বই 'কাজল'-এর বাংলা বই পিডিএফ সংগ্রহ করতে পারবেন। প্রকৃতিপ্রেমী লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উপন্যাসটি লেখার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সেটি লেখারতার আগেই তিনি মারা যান, এর পরেই বিভূতিভূষণের সুযোগ্য পুত্র তারাদাস এই অসাধারণ উপন্যাস লিখে পিতার সেই শেষ ইচ্ছা সম্পূর্ণ করেন।
No comments:
Post a Comment