মহাবিপ্লবী অরবিন্দ - সমর বসু পিডিএফ - বাংলা বই এর pdf ডাউনলোড-Bangla Digital Boi Pdf

Latest

Friday, June 17, 2022

মহাবিপ্লবী অরবিন্দ - সমর বসু পিডিএফ


 মহাবিপ্লবী অরবিন্দ - সমর বসু, দিব্য জীবনী বিষয়ক বই পিডিএফ
ডিজিটাল বইয়ের নাম- 'মহাবিপ্লবী অরবিন্দ'
লেখক- সমর বসু
বইয়ের ধরন- জীবনী বিষয়ক বই
ফাইলের ধরন- পিডিএফ
এই বইতে মোট পৃষ্টা আছে- ৬৬
ডিজিটাল বইয়ের সাইজ- ৪এমবি
প্রিন্ট ভালো, জলছাপ মুক্ত

মহাবিপ্লবী অরবিন্দ - সমর বসু পিডিএফ

লেখকের কথা-
শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম ও সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত বহু প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে গঠিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বহু স্থানেও এই ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই সব প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচী গ্রহণ করে তার রূপায়ণের ব্যবস্থা করা হয়। শ্রীঅরবিন্দের বিভিন্ন গ্রন্থের পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা তার মধ্যে অন্যতম।
এই রকম একটি প্রতিষ্ঠানে শ্রীঅরবিন্দের “The Ideal of Human Unity” গ্রন্থের একটি অধ্যায় সম্বন্ধে আলোচনা হচ্ছিল ; সেই আলোচনা-সভায় এসে যোগদান করলেন একজন অধ্যাপক, যিনি শ্রীঅরবিন্দের ভক্ত নন অথচ পণ্ডিচেরী আশ্রম দর্শন করেছেন। আশ্রম দর্শন করে এসে শ্রীঅরবিন্দ সম্বন্ধে কয়েকটি প্রশ্ন তার মনে জাগে। সেই প্রশ্নগুলির যথাযথ সমাধানের উদ্দেশ্যেই তিনি ঐ প্রতিষ্ঠানে আসেন এবং শ্রীঅরবিন্দ অনুরাগী ভক্তদের কাছে প্রশ্নগুলি তুলে ধরেন।
আমরা জানি যাঁরা দক্ষিণ ভারত ভ্রমণ করতে যান, তাদের Tour Programme এ “পণ্ডিচেরী আশ্রম দর্শন”ও একটা আইটেম হিসাবে থাকে। আশ্রম দর্শন করে এসে তাঁদের মধ্যে কারও কারও মনে হয়তো শ্ৰীঅরবিন্দ সম্বন্ধে কিছু জানবার কৌতুহল জাগে। অথচ সেই ধরনের মানুষ কিংবা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ না হলে, তাদের কৌতুহলের নিবৃত্তি ঘটে না; সাধারণভাবে এই অসুবিধার কথা চিন্তা করে, যারা আশ্রম দর্শন করেছেন এবং যারা করেননি অথচ জানতে উৎসুক, তাঁদের সকলকার কথা ভেবে—উপরোক্ত কাহিনী অনুযায়ী কয়েকটি কাল্পনিক চরিত্র এবং ঘটনা সৃষ্টি করে, প্রাচীনযুগের ঔপনিষদিক পন্থা অনুসরণ করে, প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে তাঁদের কৌতুহল নিবৃত্ত করার উদ্দেশ্যে প্রবাসীতে প্রকাশিত নিবন্ধগুলি রচনা করেছিলাম। পুস্তকাকারে প্রকাশ করার সময় মনে হল-ঐ পুরানো ধারাটি বদলানো দরকার। তাই কাঠামোটার অদল-বদল কিছু করতে
হয়েছে। যে ভাবনাটি সমগ্র রচনার মধ্যে নিবিড় ভাবে বিধৃত, কাঠামো বদলাতে গিয়ে সে ভাবনাটি যাতে ক্ষুন্ন না হয় সেদিকে অবশ্য লক্ষ্য রাখা হয়েছে। প্রবন্ধগুলির শিরোনাম অনুসারে পুস্তকটিরও নাম দেওয়া হয়েছে—“মহাবিপ্লবী অরবিন্দ”। ১৯০৫-১০ সালের বাবু অরবিন্দ ঘোষ মহাশয়কেই লোকে বিপ্লবী বলে জানেন। কিন্তু এই পুস্তকে সে-বিপ্লবের কথা নেই। যে বিপ্লব ঘটানোর জন্য তাঁকে হঠাৎ অন্তঃপুরুষের আদেশে পণ্ডিচেরী চলে যেতে হয়েছিল, সেই আধ্যাত্মিক বিপ্লবের কথাই এখানে বলা হয়েছে। মানবজাতি আজ বিবর্তনের এক পর্বসন্ধিতে এসে দাড়িয়েছে। তার আড়ালে প্রচ্ছন্ন রয়েছে তার পথ বেছে নেবার তাগিদ। মানুষের মন একটা বৈষম্যের ফেরে পড়েছে। কোনও কোনও বিষয়ে যেমন তার অসম্ভব উৎকর্ষ ঘটেছে, তেমনি আর একদিকে পথহারা উদভ্রান্তের মত মাঝপথে সে থমকে দাড়িয়ে আছে। তার নিত্যচঞ্চল প্রাণ আর মন বহির্জীবনের এমন একটা কাঠামো গড়ে তুলেছে যার বিপুল আর দুর্বল জটিলতার যেন আর অন্ত নেই। দেহ, প্রাণ আর মনের সকল দাবী, সকল ক্ষুধা মেটাতে, সমাজে, রাষ্ট্রে শাসনতন্ত্রে জীবিকায় এবং সংস্কৃতিতে সে এনেছে অভাবনীয় বৈচিত্র্য। দেহ, ইন্দ্রিয়বুদ্ধি এবং সচেতনার তর্পণের জন্য সে পুঞ্জিত করেছে নানা উপকরণের বিপুল সম্ভার। কিন্তু মানুষের মন ও বুদ্ধির সামর্থ্য সীমিত—আরও সীমিত তার ধর্মবোধ এবং অধ্যাত্মচেতনার সামর্থ্য। অথচ এই দিয়ে যে অতিকায় সভ্যতার সৃষ্টি সে করেছে, তাকে তার প্রমত্ত অহং এবং ক্ষুধিত বাসনা কী করে যে সামাল দেবে বলা কঠিন।•••
•••জগৎ জুড়ে আজ দক্ষযজ্ঞের বিপ্লব চলেছে। চারিদিকে দেখছি শুধু মনগড়া আদর্শের হানাহানি, ব্যক্তি বা সমষ্টির স্কুল বুভুক্ষার তাড়না, অন্ধ প্রাণাবেগ এবং উদ্দাম কামনার মাতামাতি, ব্যক্তির, শ্রেণীর কি জাতির স্বার্থসাধনার তুমুল কোলাহল। সমাজদর্শনে, রাজনীতিতে এবং অর্থনীতিতে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে কত হাতুড়ে মতবাদের জটলা। ভূয়া আদর্শ প্রতিষ্ঠার নামে চারিদিকে শুনছি জগাখিচুড়ি গোছের নানা জিগির—যার জন্য জুলুম করতে কি জুলুম সইতে, মরতে কি মারতে মানুষের দ্বিধা নেই। আর নিজের মতকে প্রলয়ঙ্কর মারণ-যন্ত্রের সাহায্যে পরের গলার তলায় ঠেলে দিয়েই মানুষ মনে করছে এবার আদর্শ-লোকে পৌছুবার রাস্তা মিলল।•••••••
এই সংকট মুহূর্তে জীবন সমস্যার সমাধান খুঁজতে গিয়ে আধুনিক মানুষ আশ্রয় করেছে বৈজ্ঞানিকের যুক্তি শাসিত জড়বাদ আর প্রাণবাদ। নিখুঁত জীবিকাসংস্থান যুক্ত সমাজতন্ত্র আর প্রাকৃতজনের উপযোগী গণতন্ত্র, তাকে সর্বনাশের হাত হতে বাঁচাবে-এই তার ভরসা। এ সমাধানের মধ্যে সত্য যতটুকু থাকুক, মানুষের ঈঙ্গিত প্রগতির পক্ষে একে যথেষ্ট মনে করা চলেনা। কেননা, মানুষ আজকার মত জড় আর প্রাণকেই তো চিরকাল আঁকড়ে থাকবে না। তার নিয়তি প্রতিনিয়ত তাকে আকর্ষণ করছে এক সবছাপানো চিন্ময় সার্থকতার দিকে। জগতে সর্বত্র জেগেছে একটা বিপ্লবের আলোড়ন। জাতির প্রাণচেতনা, এমন কি সাধারণ মানুষের মনও আজ জেগে উঠেছে কী এক অতৃপ্তি নিয়ে। সে চায় অতীতের আদর্শ পালটে দিয়ে একটা নূতন আদর্শের নিশানা, চায় জীবনকে একটা নুতন ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে। সমাজ জীবনে ঐক্য চাই, সৌষম্য চাই, চাই পরস্পরের সঙ্গে আত্মসংমিশ্রণ। কিন্তু কি তার উপায় ?—যেমন করেই হোক মানুষের ‘অহংএ ‘অহং'এ যে প্রতিযোগিতা আর রেষারেষি, তাকে দাবিয়ে দিয়ে ভেদজর্জর সমাজে জাগিয়ে তুলতে হবে অভেদ সিদ্ধির একটা সহজ কৌশল। উদ্দেশ্য মহৎ সন্দেহ নাই। কিন্তু উপায় সুষ্ঠু, কিনা,-সন্দেহ সেইখানেই। ভাবের স্বচ্ছন্দ প্রকাশকে ঠেকিয়ে রেখে শুধু বাছা বাছা দু’চারটি ভাবকে গায়ের জোরে বাস্তবে রূপ দেবার জিগির তোলা, ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তার টুটি চেপে ধরা, জীবনের মুক্তধারাকে যান্ত্রিকতার সংকীর্ণ খাতে বইয়ে দেওয়া, প্রাণের স্বতঃস্ফুর্ত চলনে আনা একটা কৃত্রিম একত্ব ভাবনার আড়ষ্টতা,-রাষ্ট্রের হাড়িকাঠে মানুষকে বলি দেওয়া, ব্যক্তির অহংএর জায়গায় সম্প্রদায়ের অহংকে ঈশ্বর করা- এই হয়েছে আজ জীবনসমস্যা সমাধানের উপায়। দলের অহংকেই জাতি সমাজ বা রাষ্ট্রের আত্মা বলে ঘোষণা করা একটা বিষম ভুল,—যা শেষ পর্যন্ত আনতে পারে মহতী বিনষ্টি...কিন্তু মানুষের দিব্যনিয়তির সঙ্কেত তো এই মূঢ়তার দিকে নয়। মহাপ্রকৃতি বহু পূর্বে ই এর বিড়ম্বনা চুকিয়ে এসেছে। সুতরাং আবার তার মধ্যে ফিরে যাওয়া কখনও প্রগতির নিশানা হতে পারেনা।
বস্তুতন্ত্র অর্থনীতির একটা সর্বজনীন পরিকল্পনা খাড়া করে মানুষের জীবিকার সমস্যা মেটালেই জীবনের সকল সমস্যা মিটে যাবে—এমন একটা মত আজকাল প্রচারিত হচ্ছে। তারও উপায় হল সমষ্টির খাতিরে ব্যক্তি প্রাণ-মনের কণ্ঠরোধ করে যান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ঘাড়ে কৃত্রিম একত্বের একটা বোঝা চাপানো। মানুষের প্রাণ-মনকে পিষে একাকার করে ঐক্য এনে উইপোকার সমাজের মত কর্মপটু একটা স্থানু সমাজ নিশ্চয় গড়া চলে। তাতে জীবনের গতানুগতিকতা বজায় থাকবে, কিন্তু প্রাণের উৎস যাবে শুকিয়ে। আর তাই জাতিকে ঠেলবে দ্রুত বা বিলম্বিত অবক্ষয়ের দিকে। একমাত্র ব্যক্তি চেতনার প্রসারে এবং সমৃদ্ধিতে গোষ্ঠীর চিৎসত্ত্ব এবং সাধনা আত্মসচেতন হয়ে প্রগতির পথে এগিয়ে যেতে পারে। প্রাণ এবং মনের প্রমুক্ত স্বাতন্ত্রেই চেতনার সম্যক বিকাশ সম্ভবপর।....
বর্তমান সমস্যার আরেকটা সমাধান হচ্ছে, সাধারণ মানুষের বুদ্ধি এবং ইচ্ছাশক্তিকে শিক্ষাদীক্ষায় এমন মার্জিত করে তোলা যে নতুন সামাজিক সংহতির শরিক হয়ে স্বেচ্ছায় সে তার অহংকে গোষ্ঠী, জীবনের সুশৃঙ্খলা বজায় রাখতে বলি দিতে পারে। যদি প্রশ্ন হয়—
জীবন ধারার এমন আমুল পরিবর্তন কি করে সম্ভব, তাহলে তার জবাবে পাই দুটি পরিকল্পনা। একটি হল ব্যক্তিকে নানা তথ্য ও তত্ত্বের জ্ঞান দিয়ে তার মনের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে তাকে সুষ্ঠ, ভাবনায় অভ্যস্ত করে তোলা আরেকটি হল, এমন এক সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্তন করা, যার মন্ত্রশক্তিতে চক্ষের নিমেষে মানুষ কলেছাটা আদর্শ জীব হয়ে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু মানুষের আশা আর কল্পনা যা-ই বলুক, বাস্তবের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, শিক্ষায় বুদ্ধি মার্জিত হলেই কারও হৃদয় বদলায় না।•••আবার সমাজের কলে ফেলে মানুষের প্রাণমনকে আজও কোনও আদর্শের ছাঁচে ঢালাই করা সম্ভব হয়নি।•••আত্মা আর প্রাণকে কখনও কলে ফেলে ছকমাফিক রূপ দেওয়া চলে না।•••
জড়তন্দ্রিত জীবন ও সমাজের চাপে পীড়িত মানুষ আবার হয়তো মুক্তির খোলা হাওয়া খুজবে ধর্মের মধ্যেযন্ত্রের শাসনের চাইতে ধর্মের অনুশাসনকেই সে ভাববে শ্রেয়োলাভের উপায়। বিধিবদ্ধ ধর্ম ব্যক্তির অন্তরকে উদ্ভুদ্ধ করে সাক্ষাৎভাবে কি প্রকারান্তরে তার আধ্যত্মিক বিকাশের পথ করে দিয়েছে সত্য, কিন্তু মানুষের সমাজ ও জীবনধারাকে বদলে দিতে সেও পারেনি। তার কারণ সমাজকে চালাতে গিয়ে প্রাণের নীচুতলার সঙ্গে অনেক জায়গায় তাকে রফা করতে হয়েছে। তাই সমগ্র সমাজ-প্রকৃতির আমুল রূপান্তরের সামর্থ্য কি সুযোগ তার মেলেনি।•••মানুষ এমন প্রত্যাশাও করেছে : সমাজ যদি সিদ্ধ মহাজনদের প্রদর্শিত পথে চলে •••তা হলে হয়তো মানব প্রকৃতির অভীষ্ট রূপান্তর আসতে পারে। কিন্তু মানুষের এমনতরো প্রচেষ্টা এর আগে কোথাও সফল হয়নি। •••মানুষের মজ্জাগত অহমিকা এবং প্রাণবাসনা এতই উদ্দাম যে, মনেরই সহায় মনের কানে হাজার ধর্মের কাহিনী গুঞ্জরণ করেও তাদের বাধাকে নির্জিত করা যায় না। একমাত্র জীবচেতনার পরিপূর্ণ উন্মেষে•••চিৎপুরুষের স্বরূপ জ্যোতি ও স্বরূপশক্তির পরিপূর্ণ আবেশে•••প্রাকৃত বিবর্তনের অঘটনও এই মর্ত্যের আধারে সংঘটিত হতে পারে।”
 তাঁর The Life Divine গ্রন্থের শেষ অধ্যায়ে মানবজাতির উদ্দেশ্যে শেষ আশ্বাসবাণী শুনিয়েছেন শ্রীঅরবিন্দ। এবং সেই আশ্বাসবাণী তার ব্যক্তিগত কোনও আশার কথা নয়, তাহ’ল বিধাতার যা ইচ্ছা তাই। কেননা, শ্রীমায়ের কাছ থেকে আমরা জেনেছি "What Sri Aurobindo represents in the world history is not a teaching, not even a revealation, it is a decisive action direct from the Supreme."

**পাঠকগণ, এছাড়া ঋষি অরবিন্দের আরো বই সংগ্রহ করুন-
> অরবিন্দের গীতা ৪টি খন্ড - ঋষি অরবিন্দ পিডিএফ
> শ্রীঅরবিন্দ : নিজের কথা
> শ্রীঅরবিন্দের মূল বাঙ্গলা রচনাবলী

আমরা জানি পৃথিবীতে যত মহাপুরুষ আবির্ভূত হয়েছেন, যত চিন্তাশীল মনীষী, দার্শনিক, সমাজ-সংস্কারক, ধর্মপ্রচারক, রাজনীতিবিদ এসেছেন, তারা সকলেই চেয়েছেন মানবজাতিকে উন্নততর অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করতে। তার জন্য তাঁরা নানা পথেও নির্দেশ দিয়েছেন। নানা সংগঠনও গড়ে তুলেছেন। এইভাবে সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসে কয়েকটি বিপ্লব ঘটে গিয়েছে। সেই বিপ্লবগুলি সম্বন্ধে শ্রীঅরবিন্দ তাঁর বিভিন্ন রচনায় যে সব মন্তব্য করেছেন-তার থেকে বিপ্লববাদ সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় আমরা পেতে পারি।—এই আশায়, অতি সংক্ষেপে সেই মন্তব্যগুলি এখানে উদ্ধার করা হল।'—(১)
শ্রীঅরবিন্দের মতে, রাষ্ট্রনৈতিক বিপ্লব জগতে মাত্র দু’বার ঘটেছে। প্রথম বিপ্লব ঘটে যখন বিশৃঙ্খল অসংযত গ্রামীন মানুষকে সুনিয়ন্ত্রিত করার উদ্দেশ্যে গ্রাম্য অরাজকতা দূর করে, নিয়মের শাসন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য রাজতন্ত্রের প্রবর্তন করা হয়।—এই রাজতন্ত্র যখন উচ্ছল, স্বেচ্ছাচারী এবং অত্যাচারী শাসন ও শোষণের যন্ত্রে পরিণত হয় তখন তাকে অপসারিত করে প্রজাতন্ত্রের প্রবর্তন সম্ভব করা হল দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে। এই প্রজাতন্ত্রকে অবলম্বন করে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শ। স্বাধীনতার পথ ধরে আমরা গণতন্ত্রের, সাম্যের পথ অবলম্বন করে সমাজতন্ত্রের এবং মৈত্রীর পথ অনুসরণ করে সাম্যবাদের (communism) আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়াসী হয়েছি , যদিও আমাদের সে প্রয়াস এখনও পুরোপুরি সার্থক হয়নি।
শ্ৰীঅরবিন্দের মতে, জগতে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটেছে তিনবার। প্রথম বিপ্লব ঘটে যখন গ্রামীন সমাজ-ব্যবস্থায় Earter System অর্থাৎ পণ্যের বিনিময়ে পণ্যের ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবস্থা প্রচলন করা হয়। দ্বিতীয় বিপ্লব ঘটেছিল যখন পণ্যের ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারে ধাতব মুদ্রার প্রচলন ব্যবস্থা কার্যকর করা হল। এবং এই ব্যবস্থায় যখন কাগজে লেখা প্রতিশ্রুতি পত্র প্রচলিত হল তখন ঘটল তৃতীয় বিপ্লব।  
বর্তমানে সমগ্র অর্থনৈতিক কাঠামোকে Finance ও  Economy এই দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রকৃত Financial বিপ্লব ঘটেছিল যখন দীর্ঘমেয়াদী প্রতিশ্রুতি পত্র অর্থাৎ হুণ্ডী, Bill of Exchange ইত্যাদির ব্যবস্থা প্রচলিত হয়েছিল। এর ফলে এক ধরনের Capitalism-এর জন্ম সম্ভব হয়েছে যাকে অবশ্য প্রকৃত অর্থে Capitalism বলা চলে না। 'Economy’র দিকে প্রকৃত বিপ্লব ঘটেছিল যখন পণ্যের উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থায় মানুষের শ্রম শক্তির পরিবর্তে বিদ্যুৎ এবং বাষ্পের শক্তিকে কাজে লাগানো হয়েছিল। এর ফলে উৎপাদন-পদ্ধতির উন্নতি হওয়ায় কলকারখানা গুলির উৎপাদন ক্ষমতা যেমন প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল, তেমনি, জাহাজ মোটর ও এরোপ্লেন প্রভৃতি দ্রুতগামী যানবাহনের ব্যবস্থা চালু হওয়ায় উৎপাদিত পণ্যাদির বণ্টনের জন্য দূর-দূর দেশের ‘Market' গুলিও সহজলভ্য হয়েছিল। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে Industrialism এবং Commercialism নামক অত্যন্ত জটিল ও প্রভূত ক্ষমতাপরায়ণ দুটি অথনৈতিক তত্ত্বের জন্ম সম্ভব হয়েছে। ইতিহাসে যদিও এই বিপ্লব Industrial Revolution বা শিল্প বিপ্লব নামে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেছে তবুও উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থার এই পরিবর্তনকে শ্ৰীঅরবিন্দ ঠিক বিপ্লব বলে স্বীকৃতি দেননি। কেননা, তাঁর মতে এই পরিবর্তনের দ্বারা সামগ্রিক ভাবে মানবজাতির কোনও কল্যাণ সাধিত হয়নি। যেজাতির পক্ষে অর্থনৈতিক লাভ কিছু ঘটেছে, সেই জাতির কাছে অপর জাতিকে হতে হয়েছে অর্থনৈতিক শিকার। শ্রী অরবিন্দের মতে জগতে নৈতিক জীবনের ক্ষেত্রে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন এসেছে পাঁচবার। প্রথম বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন বুদ্ধদেব । তিনি সত্যের দৃষ্টিভঙ্গীকে জৈব ব্যবহারের মধ্যে সক্রিয় করে তোলবার প্রথা প্রবর্তন করেন। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিপ্লব এনেছিলেন যথাক্রমে কনফুসিয়স্ এবং যীশুখ্রীষ্ট। কনফুসিয়াস সঙ্গতির দৃষ্টিভঙ্গীকে এবং খ্রীষ্ট প্রেমের দৃষ্টিভঙ্গীকে জৈব ব্যবহারের মধ্যে সক্রিয় করবার প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন। এর পরের দুইটি বিপ্লবের দ্বারা অহিংসার দৃষ্টিভঙ্গীকে জৈব ব্যবহারে সক্রিয় করেন জৈন জিনগন এবং ক্ষমা ও দয়ার দৃষ্টিভঙ্গীকে দৈব ব্যবহারে সক্রিয় করার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন জৈন বুদ্ধগণ। এইভাবে আমাদের নৈতিক জীবনে পাঁচবার বিপ্লব ঘটে গিয়েছে।
এ ছাড়া শ্ৰীঅরবিন্দের মতে—আমাদের মনোরাজ্যেও কয়েকটি বিপ্লব ঘটেছে। এবং সে বিপ্লব ঘটিয়েছেন সিদ্ধ যোগিগণ। সরাসরি ভাগবত চেতনার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সাধনায় সিদ্ধ হবার পর মনের গতিতে যে পরিবর্তন এসেছে—তাহল এই পর্যায়ের প্রথম বিপ্লব। দ্বিতীয় বিপ্লব ঘটেছে তখন, সরাসরি ভাগবত চেতনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে জগতের সর্বময় চেতনার সঙ্গে যুক্ত থাকার-সাধনায় সিদ্ধ হবার পর যখন মনের গতিতে পরিবর্তন এসেছে। তৃতীয়বার বিপ্লব ঘটেছে ভগবানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকার সাধনায় সিদ্ধ হবার পর, চতুর্থ বিপ্লব ঘটেছে ভাগবত আনন্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকার সাধনায় সিদ্ধ, হবার পর, এবং ভাগবত আনন্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থেকে জগতের রস-আস্বাদন করবার সাধনায় সিদ্ধ হবার পর মনের গতিতে যে পরিবর্তন এসেছে তাইতেই ঘটেছে মনোরাজ্যের পঞ্চম বিপ্লব। মনোরাজ্যের এইসব বিপ্লব ঘটে যাবার পর একদল মানুষ Divine Creation-এ অর্থাৎ সৃষ্টীর অন্তরালে একটি শক্তি ক্রিয়াশীল, এই তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়েছেন। তাহলে সামগ্রিক ভাবে বিচার করলে দেখা যাবে যে, মানবজাতির উন্নতি বিধানে যুগে যুগে যে সব বিপ্লব ঘটে গিয়েছে তার ফলে একদল মানুষ হয়েছেন Evolution অর্থাৎ বিবর্তন বাদে বিশ্বাসী আর একদল হয়েছেন Evolution অর্থাৎ বিবর্তন বাদে বিশ্বাসী আর একদল হয়েছেন Dialectic অর্থাৎ দ্বন্দ্ববাদে বিশ্বাসী এবং অপর দলটি হয়েছেন Divine Creation এর তত্ত্বে বিশ্বাসী। বৈজ্ঞানিক Evolution বাদের তত্ত্বটি সাধারণভাবে স্বীকার করেছিলেন শ্রীঅরবিন্দ যদিও তিনি ছিলেন Divine Creationএর তন্ত্রে সম্পূর্ণ আস্থাশীল। শ্রীঅরবিন্দের মতে এইসব বিপ্লবের দ্বারা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির কিছু পরিবর্তন ঘটলেও তার স্বভাবের আমূল রূপান্তর সাধিত হয়নি। কোনও কোনও বিপ্লবের ফলে হয়তো মানুষ গ্রহণ করেছে নৈর্মসন্ন্যাসবাদ আবার অন্য কোনও বিপ্লবের ফলে সমাজজীবনে কর্মের উন্মাদনা এত প্রবল হয়ে পড়েছে যে, ধর্ম জীবন এমনকি নৈতিক জীবন থেকেও মানুষ সরে গিয়েছে অনেকদূরে। এই সব বিপ্লবের মাধ্যমে মানুষের জৈব প্রকৃতির যে কিছু পরিবর্তন ঘটেছে এমন কোনও প্রমাণ আজও পাওয়া যায়নি। তাই জৈব-ব্যবহারের দিক থেকে মানুষ আজও আধা-পশুই থেকে গিয়েছে।
শ্রী অরবিন্দের মতে মানুষের যা সমস্যা তার সমাধান যদি একান্তই করতে হয় তাহলে মানুষের স্বভাবের, এবং স্বধর্মের আমূল পরিবর্তন সাধন করতেই হবে। এই প্রসঙ্গে শ্রীঅরবিন্দের বিভিন্ন গ্রন্থে বিধৃত বিভিন্ন তত্ত্বগুলিকে একত্র সংবদ্ধ করে ফরাসী মনীষী P. B. Saint Hilaire "Sri Aurobindo The Future Evolution of Man” নামক যে গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন, তার থেকে একটি উদ্ধৃতি আমরা স্মরণ করতে পারি—“If humanity is to survive a radical transformation of human nature is indispensable.” নিজের সীমানা ছাড়িয়ে মানুষকে আরও উর্ধ্বে উঠতে হবে, কিন্তু জগৎ ত্যগ করে নয়, জীবনকে অস্বীকার করে নয়।
বর্তমান দুনিয়ায় সমগ্র মনুষ্য সমাজ যে জটিল সমস্যায় জর্জরিত। তার সমাধানের উদ্দেশ্যে মানুষকে কেন তার স্বভাবের আমূল পরিবর্তন ঘটাতে হবে, সে সম্বন্ধে শ্রীঅরবিন্দ বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছেন তার 'The Life Divine' গ্রন্থের শেষ অধ্যায়ে। তাঁর এই Magnum-opus কেই আমরা তাঁর দর্শন বলে গ্রহণ করেছি।

এই বইটির পিডিএফ ফাইল সংগ্রহ করুন অথবা অনলাইনে পড়ুন
প্রিয় পাঠকগণ, এই পোষ্ট হইতে আপনারা দিব্য জীবনী বিষয়ক বই 'মহাবিপ্লবী অরবিন্দ - সমর বসু' -এর বাংলা পিডিএফ সংগ্রহ করিতে পারিবেন

No comments:

Post a Comment