সাহিত্যের সেরা গল্প - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পিডিএফ - বাংলা বই এর pdf ডাউনলোড-Bangla Digital Boi Pdf

Latest

Sunday, February 27, 2022

সাহিত্যের সেরা গল্প - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পিডিএফ


 সাহিত্যের সেরা গল্প - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বাংলা গল্প সংগ্রহ বই পিডিএফ
ডিজিটাল বইয়ের নাম- 'সাহিত্যের সেরা গল্প'
লেখক- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বইয়ের ধরন- গল্প সংগ্রহ বই
ফাইলের ধরন- পিডিএফ
এই বইতে মোট পৃষ্টা আছে- ১৫৭
ডিজিটাল বইয়ের সাইজ- ১এমবি
প্রিন্ট ভালো (ক্লিকেবল সূচীপত্র), জলছাপ মুক্ত

সাহিত্যের সেরা গল্প - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

শরৎচন্দ্রের সেরা গল্প
শরৎচন্দ্রের গল্প সম্পর্কে সমালোচকদের একটু ঔদাসীন্য অনেক দিন ধরেই আছে। তার কারণ, উনিশ শতক থেকে গত শতাব্দীর প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বছর পর্যন্ত ছোটগল্পের একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞার্থে তাঁর গল্পের। বিচার হয়েছে এবং সেই বিচারে তাঁর 'অভাগীর স্বর্গ' এবং 'মহেশ'-এর মতো দু'চারটি গল্প ছাড়া আর কোনও গল্পকেই ছোটগল্পের মর্যাদা দেওয়া হয়নি এবং এই সংকীর্ণ সংজ্ঞার্থে তিনি প্রায় অবহেলিতই থেকে গেছেন।
বিশ্বসাহিত্যের অনেক বড় গল্পকার, এমনকি নাথানিয়েল হথর্ন বা এডগার অ্যালান পো-র মতো গল্পকার—যাঁরা ছোটগল্পের একটা নিজস্ব শিল্পরূপের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে এসেছেন, তাঁদের অনেক গল্পই ছোটগল্পের অতি-সংযত সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে গভীর ব্যঞ্জনার প্রকাশ ঘটায় না। অথচ গল্প হিসেবে সেগুলি পড়লে পাঠক কখনওই ভুলতে পারে না। তাছাড়া চিরকালই যা হয়, কোনও যথার্থ শিল্পীই সংজ্ঞার্থ মেনে লেখেন না, অনুভূতি, অভিজ্ঞতা বা মুহুর্তের কোনও তাড়না থেকেই লেখেন। বলে, বিষয়ের তাগিদে সংজ্ঞার্থ-নির্দিষ্ট শিল্পরূপটি অন্য কোনও রূপের কাছাকাছি চলে যেতেও পারে, কিংবা বিষয়ের নিজস্ব তাগিদে বা লেখকের অভিপ্রায়ের টানে একটা নিজস্ব রূপও নিতে পারে। তেমনি আবার অনেকটা সময় দিয়ে একটা চরিত্রের পরিবর্তন ঘটানোর প্রয়োজন হতে পারে, একটি পরিস্থিতির বিস্তৃত বিবরণও থাকতে পারে। কিন্তু তাই বলে সেগুলিকে বিশেষ সংজ্ঞার্থের সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না ভেবে অবহেলা করার কোনও কারণ নেই। আইজ্যাক সিঙ্গারের বিখ্যাত গল্প Gimpel the Fool বা তারাশঙ্করের 'ডাইনী' বা 'পৌষলক্ষ্মী' কি আকারে খুব ছোট? গল্পগুলিতে বর্ণনার অতিসংযম নেই। খুবই প্রয়োজনীয় ঘটনা-নির্বাচন-দক্ষতা বা গভীর ব্যঞ্জনা যদি বা থাকে, তবু তাকে অতি অল্প। রেখায় তার তীব্রতাকে বোঝানোর চেষ্টাও নেই। বরং তিনটি গল্পই বর্ণনাধর্মী, অনেকগুলি ঘটনা বা পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে চরিত্র-বিকাশে ধীর গতি বা সম্পর্কের নাটকীয় পরিস্থিতিকে ক্রমশীর্ষে উন্নীত করার জন্যে দীর্ঘ সময়ব্যাপী প্রস্তুতি-সাপেক্ষ। অথচ গল্প হিসেবে যে-কোনও বিচারে তিনটিই অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পের মর্যাদা পাবে। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের সব গল্পই কি 'ছোটগল্প'-সংজ্ঞার্থের বিচারে খুব উন্নত মান পাবে? বিশেষ করে নষ্টনীড়, স্ত্রীর পত্র, মেঘ ও রৌদ্র কিংবা তিনসঙ্গীর গল্পগুলি কি স্বল্পতম বসনে সজ্জিত সুন্দরী? কিন্তু শক্তিশালী গল্পকারের অনেকগুলি লক্ষণ গল্পগুলির মধ্যে আছে। বলেই আমরা গল্পগুলিকে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্বেও মুল্যবান মনে করি। 'নষ্টনীড়' তো ছোটখাটো উপন্যাসের মতো, মূলঘটনা ছাড়া অন্য উপকাহিনিও এসে পড়েছে এই গল্পে।
তাই বলছি, ছোটগল্পকার শরৎচন্দ্রের কথা ভুলে গিয়ে আমাদের উচিত নিছক গল্পকার হিসেবেই শরৎচন্দ্রের দক্ষতা বা ভুলত্রুটি বিচার করা। বিশেষ করে শরৎচন্দ্র সেই জাতীয় শিল্পী যিনি কোনও প্রতিষ্ঠিত শিল্পকর্মের রূপগত খুঁটিনাটির কথা না ভেবেই মোটামুটি একটা ধারণার ওপর নির্ভর করে একটি শিল্পকর্ম গড়ে তোলেন। তবু তথাকথিত শিল্পরূপের একটা আভাস তাঁর 'অভাগীর স্বর্গ' বা 'মহেশ' ছাড়াও অন্য গল্পে যে পাওয়া যায় না তা নয়। উদাহরণস্বরূপ 'আলো ও ছায়া' গল্পটির কথাই তুলি। গল্পটি যে অসাধারণ ভালো গল্প তা বলব না। কিন্তু ফর্মগত পরিমিতিবোধে 'আলো ও ছায়া'-কে ছোটগল্পই বলব। সুনির্বাচিত কিছু ঘটনা, নিতান্ত প্রয়োজনীয় বিবৃতি এবং অধিকাংশ ক্ষেত্ৰই সংলাপ এবং ওই বিবৃতির মধ্যেই আবার প্রতুল-সুরমা-যজ্ঞদত্তের মনস্তাত্বিক জটিলতার ইঙ্গিত ছোটগল্পে প্রত্যাশিত রূপগত সংযমেরই পরিচয় দেয়। শেষ পর্যন্ত নারী-পুরুষের অবৈধ সম্পর্ক-জনিত অবদমিত মানসিকতা হঠাৎ যে আচরণগত অতিনাটকীয়তায় মর্মান্তিক হয়ে উঠতে পারে তারই ইঙ্গিত আছে গল্পে। যেখানে সামাজিক বিধিনিষেধ যজ্ঞদত্ত-সুরমার মিলনকে স্বাভাবিক করে তুলতে পারে না। সেখানেই যে প্রতুলের মতো নিরীহ শান্ত মেয়েকে বলি হতে হয় এমন একটি তীক্ষ মর্মভেদী। পর্যবেক্ষণই যেন গল্পটির মূল তাৎপর্য। যজ্ঞদত্তের আত্মঘাতী হয়ে ওঠার পরিস্থিতিতে যতোই অতিনাটকীয়তা থাক, অবদমতি বাসনার মধ্যেই তার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কিন্তু গল্পের সৌন্দর্যটি আসলে তিনটি চরিত্রেরই পারস্পরিক সূক্ষ্ম ও প্রায় নীরব পরিচয় গ্রহণে। তিনজনেরই মর্মজ্বালার ব্যঞ্জনা গল্পটির মধ্যে রূদ্ধশ্বাস কারুণ্য এনেছে।
একটি গল্প ধরে কথাগুলো বলছি এই জন্যে যে শরৎচন্দ্রের গল্পেও পরিমিতিবোধ ছিল, কাহিনির সবটুকু বিবৃতিতে না বলে কয়েকটি নির্বাচিত পরিস্থিতিকে স্বল্পরেখায়, অনেক সময় সংলাপের গূঢ় অর্থময়তায় প্রকাশ করে দ্রুত পরিণতিতে নিয়ে যাওয়ার প্রমাণ ছিল। যে কোনও কারণেই হোক, শরৎচন্দ্রের এই দক্ষতার দিকটি আমরা অবহেলা করেছি।
'হরিলক্ষ্মী' গল্পটিতে, হরিলক্ষ্মী ও কমলার মধ্যে একটি সূক্ষ্ম প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছবি আছে যার মনস্তত্ব বোঝা একটু শক্ত। হরিলক্ষ্মী কমলাকে যে ভালোবাসতো তার প্রতিদান পায়নি। কিন্তু কমলার স্বামী কমলাকে যখন অত্যাচার করেছে তখন সুযোগ থাকলেও সে প্রতিবাদ করেনি। নিজের স্বামীর ওপর অশ্রদ্ধার জন্যেই কি কমলার স্বামীর ব্যবহারে সে নির্বিকার ছিল? অন্যদিকে কমলার ঔদাসীন্যের কারণ কী হতে পারে? হরিলক্ষ্মী বড় ঘরের স্ত্রী বলে? নিজের দারিদ্র্যের অহংকার? চারিত্রিক দৃঢ়তা কি সেই কারণেই? নানান সম্ভাবনা থেকেই যায়। এবং তাতেই লেখকের অভিপ্রায়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে না।
কিন্তু 'বঙ্গবাণী' পত্রিকায় প্রকাশিত মহেশ ও অভাগীর স্বর্গ (যথাক্রমে আশ্বিন ও মাঘ, ১৩২৯) আকারে-প্রকারে যথার্থই ছোটগল্প। 'মহেশ' আর 'অভাগীর স্বর্গ'—দুটি গল্পেই জাতপাতের প্রশ্নটা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। ধাপে ধাপে কতগুলো নিষ্ঠুর ও করুণ ঘটনার মধ্য দিয়ে হিন্দু-প্রধান গ্রামের মুসলমান ভাগ-চাষির মর্মান্তিক পরিণতি দেখিয়েছেন শরৎচন্দ্র বেশ পরিকল্পিত ভাবে, নাটকীয় উত্তাপ ক্রমশ বাড়িয়ে বাড়িয়ে। বিপর্যয়গুলো এসেছে একটি অনাহারী শীর্ণ প্রাণীর পাশাপাশি তার প্রভুরও সহ্যশক্তির সীমাকে ধীরে ধীরে ভেঙে দিয়ে। জন্তুর উদ্দামতা ভেঙে দিয়েছে মানুষের ধৈর্যের বাঁধকে। কিন্তু জন্তুর প্রতি গভীর স্নেহবন্ধনে মানুষ তার নিজের অপরাধের শাস্তি চেয়েছে, কিন্তু জন্তুটি অনাহারে থাকার জন্যে যারা দায়ী তাদেরও শাস্তির জন্যে প্রার্থনা করেছে। মানুষ ও জন্তুর এই অচ্ছেদ্যবন্ধন, মুসলমান চাষির প্রতি ব্রাহ্মণ পুরোহিত ও জমিদারের তাচ্ছিল্য ও ঘৃণা, অবস্থার চাপে সর্বস্ব খুইয়ে অসহায় মুসলমান চাষির গ্রাম-ত্যাগ এবং নিকটবর্তী চটকলে শ্রমজীবী হওয়ার ইচ্ছে—এ সবেরই ভেতর দিয়ে সমাজের অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত গল্পটিকে একই সঙ্গে সুগভীর মানবিক ও সামাজিক মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। একটা হয়রানি বা পরিহাসের রেশও গল্পটিতে থেকে গেছে। 'মহেশ' নামটি রাখার মধ্যে যেমন খেটে-খাওয়া মানুষের সমাজে ধর্মীয় ভেদরেখা মুছে যাওয়ার ব্যাপারটারই ইঙ্গিত পাই, তেমনি মহেশকে খেতে দেয় না বলে (আসলে খেতে দিতে পারে না' বলে) তর্করত্নের মুখে গফুরকে 'ব্যাটা কসাই' বলে যে গালাগাল শুনতে হয়, শেষ পর্যন্ত তা সত্যি হয়ে গেছে। মহেশের 'কসাই' হয়েই গফুরকে গ্রাম ত্যাগ করতে হয়েছে।
অন্যদিকে 'অভাগীর স্বর্গ' গল্পেও জাতপাতের প্রশ্নই এসেছে। মহেশ-এ আছে হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ। এ-গল্পে হিন্দু সমাজের মধ্যেই বিভেদ—ব্রাহ্মণ আর 'ছোটজাত' দুলে-র বিভেদ। এ গল্পে ও 'মহেশ'-গল্পের মতো নাটকীয় ক্রমপর্যায়ে ঘটনার বিন্যাসে শিল্পসচেতনার আভাস পাই। লেখক বেশ সতর্ক আয়ােজনেই অভাগীর স্বর্গবাসের কল্পনাকে মাটি চাপা দিলেন। জাতপাতের পার্থক্যে 'ছোটজাত'-এর সৎকার যে জন্তু-জানোয়ারেরই সকারের সামিল তা গল্পটিতে খুব স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে। এবং 'মহেশ'-এর মতো এই গল্পেও দেখি, জাতপাতের বৈপরীত্যের মধ্য দিয়েই মর্মান্তিক আয়রনি এসেছে। 'ছোটজাত' বলে তখন কিন্তু কেউ ঘেন্না করতে পারবে না—দুঃখী বলে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।'—অসুস্থ অভাগীর এই উচ্চারণকে স্পষ্টতই ঘটনার সুচিন্তিত বিন্যাসে নিষ্ঠুর পরিহাসে শেষ করা হল। ঠাকুরদাসের স্ত্রীর চন্দন-ধূপ সুবাসিত চিতার ধোঁয়া আর অভাগীর মুখে--ছোঁয়ানো খড়ের ধোঁয়ার মধ্যে কতো যে তফাত তা বুঝিয়ে দেওয়া হল।  দুটি গল্পের ক্ষেত্রেই ছোটগল্পের প্রথাগত বিন্যাসে পরিকল্পিতভাবেই ঘটনার পর্ব-পর্বান্তরে একই ধরনের ক্লাইম্যাকস আনা হয়েছে। দুটি গল্পেই ধনী-নির্ধন, শোষক-শোষিত, জাত-বেজাত, উঁচুজাতনীচুজাত এই স্পষ্ট বৈপরীত্যেই সামাজিক সমস্যাকে শিল্পরূপ দেওয়া হয়েছে। এই বৈপরীত্য খানিকটা সাজানো মনে হতে পারে, হয়তো অবিমিশ্র ভালো-মন্দ বলে সংসারে কিছু নেই, তবু বিশেষ বিশেষ সামাজিক অবস্থানে মানুষের যে একপেশে রূপটা প্রকাশ পায়, ভালো-মন্দের সেই বিপরীত রূপ দুটি ধরে নিয়েই সমাজের সমস্যাকে রূপ দেওয়া হয়েছে। যে সামাজিক ও নৈতিক অবিচার অমানুষিক সমস্যার জন্ম দেয় শরৎচন্দ্র তাঁর অন্য অনেক গল্প-উপন্যাসের মতো এখানেও তাঁর সমবেদনা সেই সমস্যার চিহ্নিত মর্মবেদনাকে তুলে ধরেছেন।
'অনুরাধা', 'সতী' এবং 'পরেশ' এই তিনটির মধ্যে 'সতী' গল্পের বিন্যাসে ও বক্তব্যে একটু নতুনত্ব আছে। অসতীর মধ্যে শরৎচন্দ্র এতকাল সতীত্ব খুঁজেছেন। কিন্তু সতীত্বও যে অসহ্য হতে পারে তার প্রমাণ এই গল্পটি। স্ত্রীর ভালোবাসা যেখানে ঈর্ষা ও সন্দেহ জাগিয়ে পদে-পদে স্বামীর জীবন অতিষ্ঠ করে তুলতে পারে, সেখানে সতীর আতিশয্য ভুক্তভোগীর জীবনে ট্রাজেডি নিয়ে আসতে পারে, বিন্যাসের কৌশলে তাতে কৌতুকের যথেষ্ট উপাদান মিলতে পারে। অন্যত্র যা শরৎচন্দ্র করেননি, এখানে তাই করেছেন। হরিশের মর্মজ্বালার মধ্যে গভীর কৌতুক মিশিয়েছেন। ফলে গল্পটিতে যে মিশরস সৃষ্টি হয়েছে তাতে শরৎচন্দ্রের অন্য এক দক্ষতার পরিচয় মিলেছে। 'পরেশ' গল্পটিতে এক সৎ স্নেহশীল ও তেজস্বী মানুষ কীভাবে আত্মীয়-স্বজনের নিষ্ঠুর আঘাতে অশ্রদ্ধেয় হয়েছেন তার ছবি আছে। কিন্তু নীচ অকৃতজ্ঞ পরেশ তার জ্যাঠামশায়ের সঙ্গে ব্যবহারে যে বিরোধিতা করেছে তার। আকস্মিক পরিবর্তনে তেমন কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। শরৎচন্দ্রের চরিত্র-বিকাশে মাঝে মাঝে যে আকস্মিকতা দেখা যায় এখানেও তা ব্যতিক্রম নেই। আর 'অনুরাধা'-র মধ্যেও দেখা যায় বিজয়ের প্রতি অনুরাধার আকর্ষণের যথেষ্ট ব্যাখ্যার অভাব। বিজয়ের পুত্রের জন্যে তার যে বাৎসল্য জেগেছে তাতেই সে বিজয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে কিনা বোঝা যায় না। ছেলের প্রতি স্নেহমমতা জাগলে যে ছেলের বাবার ওপর শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জাগবে এমন কোনও কথা নেই। বিশ্লেষণে অমনোযোগই। গল্পটির সম্ভাবনাকে নষ্ট করেছে।
অনেক ত্রুটি চোখে পড়লেও যে গল্পগুলিতে শরৎচন্দ্রের দক্ষতা স্পষ্ট সেগুলির কাহিনি-বিন্যাস, নাটকীয়-কৌশল, পরিস্থিতি-সৃষ্টি এবং সংলাপ এতোই ঘরোয়া ও আন্তরিক যে গল্পের আকারগত সংহতির প্রথাগত সংজ্ঞার্থকে সহজেই ভুলতে হয়। বিশেষ করে গ্রামের ভালোমন্দ-স্বভাবের বিচিত্র মানুষ, উঁচু-নীচু জাতের প্রভেদ, সামাজিক বিধি-নিষেধে নারী-পুরুষের, বিশেষত নারীর আত্মপীড়নের মর্মজ্বালা এবং সামাজিক নিপীড়নের ছবি, ভালোবাসা ও বাৎসল্যের সহজ কিংবা তির্যক গতি শরৎচন্দ্রের গল্পে যে 'সুপরিচয়ের রস' সৃষ্টি করেছে, তা রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছে এমন নাটকীয়ভাবে এবং এতো বিপুল কারুণ্যে ফুটে ওঠেনি, যদিও অনেক ক্ষেত্রে এ সব কিছুর সতর্ক রূপরেখা রচনা রবীন্দ্রনাথেরই হাতে শুরু। তাই মনে হয়, ছোটগল্পের রূপ-রীতি নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। কারণ শুধু বিশ্বসাহিত্য কেন, বাংলা সাহিত্যের অনেক বিখ্যাত গল্পেই নিছক আকারগত সংহতির কোনও লক্ষ্মণ নেই। অন্যদিকে ছোটখাটো ঘরোয়া বিষয়গ্রহণে, পারিবারিক সম্পর্কের প্রেম-স্নেহ-প্রীতিপ্রকাশের বিশ্লেষণে ও বিন্যাসে শরৎচন্দ্রের অনেক গল্পই ছোটগল্পের নির্দিষ্ট সংজ্ঞার্থ না মেনেই ভালো গল্প হিসেবে এখনও আমাদের আকর্ষণ করে। 'আলো ও ছায়া', 'বিলাসী', 'মহেশ', 'অভাগীর স্বর্গ', কিংবা 'সতী'-র মতো গল্পে শরৎচন্দ্র সমাজের মানুষকে অনেক ব্যাপকভাবে দেখেছেন, শ্রেণিগত অভিজ্ঞতায় পূর্বসূরীদের অনেকটাই ছাড়িয়ে গেছেন এবং নীচুজাতের মানুষকে তো বটেই, পরিচিত মধ্যবিত্তের অন্দর মহলের ছবিতেও এমন আন্তরিক ও ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণের প্রমাণ তাঁর স্বাতন্ত্র ও সহজাত দক্ষতারই পরিচয় দেয়।
হরিচরণ, বাল্যস্মৃতি, ছেলেধরা ইত্যাদি গল্পগুলো পড়লে বোঝা যায়, অত্যন্ত ঘরোয়া আটপৌরে ভাষার শিশু-কিশোরের দুরন্তপনা, জীবজন্তু ও মানুষের মধ্যেকার মায়া-মমতার সম্পর্ক কিংবা দৈনন্দিন সংসারের দুঃখ-সুখের ঘটনাকে কী অসাধারণ সংযমেই না তিনি ধরে নিতে পারতেন! জীবজন্তু নিয়ে গল্প তো আমাদের গল্প সাহিত্যে খুব বেশি নেই। সেদিক থেকেও 'মহেশ' গল্পের মহেশ এবং শরৎচন্দ্রের সেরা গল্প'দেওঘরের স্মৃতি'-র পথের কুকুরটি মানুষ এবং অন্য প্রাণীর ভেতরকার আত্মীয়তার অম্লান করুণ ছবিবা প্রতীক হয়েই বেঁচে থাকবে।

এই বইটিতে যে বারোটি অনন্য গল্প রয়েছে-

হরিচরণ
মামলার ফল
হরিলক্ষ্মী
মহেশ
অভাগীর স্বর্গ
সতী
পরেশ
বাল্য-স্মৃতি
মন্দির
আলো ও ছায়া
বিলাসী
অনুরাধা


এই বইটির পিডিএফ ফাইল সংগ্রহ করুন অথবা অনলাইনে পড়ুন
প্রিয় পাঠকগণ, এই পোষ্ট হইতে - শরৎচন্দ্রবাবুর লেখা অনন্য গল্প সংগ্রহ বই 'সাহিত্যের সেরা গল্প' -এর বাংলা পিডিএফ সংগ্রহ করিতে পারিবেন।

No comments:

Post a Comment