উজান - সুচিত্রা ভট্টাচার্য, বাংলা গল্প পাঠ - বাংলা বই এর pdf ডাউনলোড-Bangla Digital Boi Pdf

Latest

Sunday, August 2, 2020

উজান - সুচিত্রা ভট্টাচার্য, বাংলা গল্প পাঠ


বাংলা গল্প পাঠ-এ আজকের অণু-উপন্যাস- 'উজান' লিখেছেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য। এই গল্পটি সানন্দা পত্রিকায় ১৯৯৩ সালের অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
 এই গল্পের ঘটনাটি নন্দিতাকে কেন্দ্র করে, উনি কলেজে অধ্যাপনা করেন।  পূজোর ছুটির সময়ে  স্বামী ও মেয়ের সাথে দিল্লি ভ্রমণে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে রাকা নামে একজন সুন্দরী মহিলার সাথে ট্রেনে পরিচয় হয় যাকে নন্দিতা তার প্রথম স্বামীর স্ত্রী বলে সন্দেহ করেন। তারপর থেকেই নন্দিতা'র মনে তার ফেলে আসা জীবনের পুরানো চিত্রগুলি তার মনের মধ্যে চপানউতর শুরু করে। পুরো গল্পটা পড়ে ফেলুন, ভালোই লাগবে।


উজান 

সুচিত্রা ভট্টাচার্য

উজান - সুচিত্রা ভট্টাচার্য

মন যে কখন কী চায়, মনই কি জানে !
এই যে প্রতিবার পুজোর ছুটিতে কলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে নন্দিতা অথচ বাইরে এসে কদিন যেতে না যেতেই কলকাতার জন্য মন উথালপাতাল, আবার এই যে ফেরার পথে বুকের ভিতর আরেকটা অন্যরকম দানা দানা কষ্ট, এরকম কেন হয় ! এসব সময়ে নন্দিতার স্নায়ু বড় বেশি টান টান হয়ে থাকে। একটু টোকা পড়লেই বিস্ফোরণ। এবারও তার ব্যতিক্রম হল না।
শেষ মুহূর্তে নির্দিষ্ট কোচ খুঁজে সিট বার্থের দখল নেওয়ার আগেই ছেড়ে দিয়েছিল ট্রেনটা। একটু আগের চাপা ভিড় অনেকটা হাল্কা হয়ে এলেও, এখনও এদিক ওদিক ঘুরছে যাত্রীরা, নিজেদের মালপত্র সামলাচ্ছে। শ্যামলেন্দুর সঙ্গে নন্দিতাও স্যুটকেস হোল্ডঅল খাবার প্যাকেট সব তুলে রাখছিল বাংকের উপর, এমন সময় হঠাৎই পাশে রাখা স্যুটকেসটার গায়ে চোখ আটকে গেল তার । ছাইরঙ স্যুটকেসের গায়ে কালোসাদা স্টিকারে জ্বলজ্বল করছে নামটা । রাকা রায়। নামটা বড় চেনা চেনা না! নন্দিতা পলকের জন্য থমকাল। পলকের জন্যই। পরক্ষণেই মন চলে গেছে অন্যদিকে। তাদের জানলার ধারের সিটটায় বসে আছে এক অবাঙালি তরুণ। গাঁট্টাগোট্টা। বছর চব্বিশেক বয়স । ছেলেটা এখানে কেন ! এ সিটটা তো নন্দিতাদের । নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার নিজেদের বার্থনাম্বারগুলো মিলিয়ে নিল নন্দিতা। একচল্লিশ, বিয়াল্লিশ, তেতাল্লিশ। ঠিকই আছে। জানলার সিটটা তাদেরই । ছেলেটাকে উঠে যেতে বলবে ! ভাবতে গিয়েই নন্দিতার খেয়াল হল রিমলি পাশে নেই। গেল কোথায় ! এই তো ছিল ! নন্দিতা ছটফট করে উঠল, —রিমলি, রিমলাইই....
নন্দিতার মেয়ে সাড়া দিল পাশের কুপে থেকে,
—এই যে মা, আমি এখানে।
—ওখানে কী করছিস তুই !
—কিছু না। জানলার ধারে বসে আছি।
—ওখান থেকে কোত্থাও যেও না যেন।
নন্দিতা অবাঙালি ছেলেটার পাশে বসে ওয়াটার বটল খুলে দু ঢোঁক জল খেল। জানলার বাইরে বিকেলের রোদ এখন ঝকমকে পিতলবরন। সেই রঙ মেখে দ্রুত পিছনে যাচ্ছে দিল্লির শহরতলি। হারিয়ে যাচ্ছে । নন্দিতার বুকটা আবারও হু-হু করে উঠল। কোনও কিছু ফেলে যাওয়া সবসময়ই বড় কষ্টের। সবারই কি এরকম খারাপ লাগে ! নাকি শুধু নন্দিতারই। জানলা থেকে চোখ সরিয়ে নন্দিতা নিজেদের কুপেটায় চোখ বোলাল আরেকবার। নন্দিতা আর শ্যামলেন্দুর মুখোমুখি, সামনের সিটে, অল্পবয়সী এক স্বামী-স্ত্রী। দেখেই বোঝা যায় নতুন বিয়ে হয়েছে। একটু ঘন হয়ে বসে এর মধ্যেই পরস্পর মগ্ন হয়ে গেছে কথায় । খুব ঝলমলে একটা সালোয়ার-কামিজ পরেছে মেয়েটি, হাতভর্তি এত্ত কাচের চুড়ি । ওদের পাশে, জানলার ধারের মহিলাটি নন্দিতারই সমবয়সী প্রায়। রীতিমতো সুন্দর । টকটকে ফসা রঙ। চোখ দুটো বেশ বড় বড়, টানা । কানে দুল নেই। গলায় ইমিটেশন মফচেন। সিঁথির সিঁদুরটা ভীষণ সূক্ষ্ম । হাতের সরু সরু শাঁখা পলা বলে দেয় ভদ্রমহিলা বাঙালিই । ইনিই কি রাকা রায় ? নাকি অন্য মেয়েটি ? রাকা রায় নামটা আগে কোথায় শুনেছে নন্দিতা ? কোথায় যেন ?
নন্দিতা ভদ্রমহিলার সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করল, —কলকাতা যাচ্ছেন ?
মহিলা হাসল ভারী সুন্দর করে, —হুঁ।
—একা ?
—হ্যাঁ। সঙ্গে দাদার আসার কথা ছিল। আসতে পারল না।
—দিল্লিতেই থাকেন ?
—উহু। কলকাতায়। দিল্লি এখন আমার বাপের বাড়ি। দাদা থাকে। মাকে নিয়ে।
—আমার দাদাও কিছুদিন দিল্লিতে ছিল।
কথাটা বলেই দম করে আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে নন্দিতা । দাদার সঙ্গে সম্পর্কটা হঠাৎই কেমন চিড় খেয়ে গেল। অথচ একসময় তাকে কী ভালই না বাসত দাদা। সেও তো ! একটা বয়স অবধি দাদাই তো নন্দিতার একমাত্র আইডল। কেন এমন হয় ! ভাইবোনের সম্পর্ক ছিড়ে যায় বিশ্রীভাবে। নাকি সব সম্পর্কের বেলাতেই নিয়ম এক। স্বার্থ এসে পড়লে সব সম্পর্কেই ভিত নড়ে যায় ! তা সে সম্পর্ক ভাইবোনেরই হোক, কি স্বামী-স্ত্রীর। কিংবা বাবা মা ছেলেমেয়ের। অথবা বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর।
অবাঙালি যুবক এখন এমনভাবে ঝুঁকে বসেছে যে বাইরের পৃথিবীটা প্রায় চোখের আড়াল । নন্দিতার খুব খারাপ লাগল । কিছু কিছু মানুষ এমন স্বার্থপর হয় ! কেমন অন্যের জায়গা জুড়ে নির্বিকার বসে আছে দ্যাখো । সামনের মহিলা মুখ ফিরিয়ে দিব্যি বাতাস মাখছে মুখে, নন্দিতা কনুই দিয়ে আলগা খোঁচা দিল শ্যামলেন্দুকে, —ওই ছেলেটাকে উঠে যেতে বলো।
শ্যামলেন্দু হাতের কাজ সেরে যথারীতি একটা পেপারব্যাক খুলে বসেছে। নন্দিতার কথা প্রথমটা ঠিক মতো ধরতেই পারল না,
—কাকে ?
—চোখ নেই ? দেখতে পাচ্ছ না ? বিরক্ত হলেও নন্দিতা বেশ নিচু স্বরেই বলছিল কথাগুলো, —জানলার ধারের সিটটা আমাদের।
শ্যামলেন্দু পাত্তা দিল না, —ও এমনই বসেছে। বসুক না। উঠে যাবে।
নন্দিতার গলা উঠল, —হ্যাহ, সবাই তোমার মতো উদার কি না।
—আস্তে বলো। শ্যামলেন্দু ত্রস্ত চোখে চারপাশটা দেখে নিল। ভাবটা এমন যেন নন্দিতাই লোকটাকে উঠতে বলে কোনও গর্হিত আচরণ করে ফেলেছে।
নন্দিতা গুম মেরে গেল। এসব মুহূর্তে তার নিজেকে বড় অসহায় লাগে। শ্যামলেন্দু তার কোনও কথাই সহজে বুঝতে চায় না। এই যে এখন জানলার ধারে বসে প্রচণ্ড হাওয়ায় মাখামাখি হয়ে বুক ভরে একটু দম নিতে চাইছে নন্দিতা, এটাও মুখ ফুটে খুলে বলতে হবে । নতুবা শ্যামলেন্দু কিছুই বুঝবে না।
কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ থেকে নন্দিতা শেষে রিমলিকেই ডাকল, রিমলি, এবার এদিকে চলে এসো।
রিমলি তক্ষুনি দৌড়ে এসেছে, ওদিকের পাঞ্জাবিগুলো কী ভাল বাংলা বলে মা ।
—ছি। নন্দিতা মেয়েকে শাসন করল, ওকি। কথার ছিরি, আঙ্কল বলতে পারো না ?
রিমলি ঢোঁক গিলল, —সরি। সরি । আঙ্কল। ওই আঙ্কলরাও না কলকাতাতেই থাকে মা ।
—ঠিক আছে। আঙুল চালিয়ে মেয়ের চুল ঠিক করে দিল নন্দিতা, এবারে এখানে বোস।
—ওখানে আমি জানলার ধারে বসেছিলাম । উ-উ-উ।।
নন্দিতা আড়চোখে শ্যামলেন্দুর দিকে তাকিয়ে নিল। মেয়েকে বলল, —এখন এখানেই বোসো।
—না আমি জানলার ধারে বসব।
—তোমার বাবাকে বলো।
জানলা দখলকারী যুবক রিমলির দিকে হাসি , হাসি মুখে তাকিয়ে থাকলেও নিঘাত একবর্ণ ভাষা বুঝছে না, না হলে একটু লজ্জা তো পেত নিশ্চয়ই।
—ও মা....
—আমি কী জানি, বললাম না বাবাকে বলো । সামনের জানলায় বসা মহিলা হুট করে বলে বসল, তুমি এখানে বসবে ? এসো। বসো।
রিমলি মাথা নাড়ল, দূর,ওদিকে হাওয়া নেই। ওটা তো উল্টোদিক ।
নন্দিতারও ইচ্ছে নেই মেয়েকে সোজাসুজি হাওয়ায় বসতে দেওয়ার, তবু চুপ সে।
রিমলি শ্যামলেন্দুকে ঠেলা দিল, —বাবা, ও বাবা....
শ্যামলেন্দুকে বই বন্ধ করতেই হল। নন্দিতার দিকে তাকিয়ে হতাশভাবে মাথা নেড়ে সামনের দিকে ঝুঁকেছে। বিনীত গলায় বলছে, —মাফ করনা ভাইসাব, এ সিট শায়েদ হামারা হ্যায় ।
—ম্যায় কানপুরমেহি উতর যাউঙ্গা।
শ্যামলেন্দু পাছে বিগলিত হয়ে পড়ে, নন্দিতা তাড়াতাড়ি হাল ধরে নিল, —হামারা লেড়কি উহা বৈঠেগি । আপ দুসরা কোই জগাহ ঢুঁড় লিজিয়ে।
শ্যামলেন্দু বলে উঠল, —নেই, নেই, আপ ইধর ভি বৈঠ সকতে হেঁ।
—নেহি, ঠিক হ্যায় । আপলোক আরামসে বৈঠিয়ে ।
নন্দিতার কথার রুক্ষতায় ছেলেটি আহত হয়েছে বোঝা যায়। নন্দিতার ইচ্ছে হল ছেলেটিকে নিজে একবার বসতে বলে, পারল না। আরও মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল তাতে। মাঝে মাঝে কী যে হয়ে যায় তার ! লাগাম টেনেও মনের রাশ ধরতে পারে না। সামনের ওই দম্পতি, ওই হাসিমুখ মহিলা নিশ্চয়ই তাকে খুব দুর্মুখ ভাবছে। ইশশ। রিমলি জানলার ধারে বাবু হয়ে বসে গল্প জুড়েছে সামনের মহিলার সঙ্গে, —তুমি একা একাই যাচ্ছ ? তোমার বুঝি ভয় করে না ?
—উহু।
—আমাকে মা একা একা কোত্থাও যেতে দেয় না। মা খুব ভিতু।
নন্দিতা কথা বলে সহজ করতে চাইল নিজেকে, —মেয়ের কথা শুনেছেন ? সব সময়ে এরকম পাকা পাকা কথা ।
—পাকা পাকা কোথায় ! বেশ মিষ্টি তো।
—মিষ্টি না ছাই। একটু পরেই আপনাকে পাগল করে ছাড়বে।
—না, না পাগল করবে কেন ? মহিলা হাত বাড়িয়ে গাল টিপে দিল রিমলির, চকোলেট খাবে ? বলেই উঠে দাঁড়িয়ে বাংক থেকে স্যুটকেস নামাল। রাকা রায় লেখা স্যুটকেসটা।
নন্দিতা থমকেছে নতুন করে। এই তবে রাকা রায় ! রাকা রায় কার নাম ? রানুদির জায়ের নাম ? সিদ্ধার্থর বউ-এর নাম ? ওফফফ মনে পড়েছে। রাকা তো অরুণের বউয়ের নাম। হ্যাঁ, রাকাই তো। অরুণ রায়ের বউ রাকা রায়। নন্দিতার ভুরুতে ভাঁজ পড়ল। এই রাকা রায় কি সেই রাকা রায় ? দূর, তার দিল্লিতে বাপের বাড়ি হতে যাবে কেন ? নন্দিতা যতদূর শুনেছে অরুণ যাকে বিয়ে করেছে সে শ্যামবাজারের মেয়ে। সুমিতা সেরকমই রিপোর্ট দিয়েছিল। না, না, এ সে নয়। একই নামে দুটো মেয়ে থাকতেই পারে। তবে সেও তো শুনেছে বেশ সুন্দরী। তা বলে কি আর এত সুন্দর ?
মনে মনে হাজার যুক্তি সাজিয়েও কে জানে কেন কিছুতেই নিঃসংশয় হতে পারছিল না নন্দিতা। মহিলাকে জিজ্ঞাসা করতেও বুক ঢিপঢিপ করছে। সত্যি যদি সেই রাকাই হয় ! শেষ পর্যন্ত কৌতূহলের কাছে দ্বিধা হার মানল । —আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে। কলকাতায় কোথায় থাকেন বলুন তো আপনি ?
—সাউথে। ভবানীপুর ।
—ভবানীপুরের কোথায় ?
—পূর্ণ সিনেমার কাছে।
পূর্ণ সিনেমা ! নন্দিতার শরীরের সমস্ত শিরাউপশিরাগুলো এবার একসঙ্গে ঝনঝন করে বেজে উঠেছে। আর কোনও সন্দেহই নেই । সে। সেই।
—আপনারা কোথায় থাকেন ?
—রানিকুঠি। নন্দিতা আড়ষ্ট উত্তর দিল । হৃৎপিণ্ডে পাগলাঘণ্টিটা বেজেই চলেছে। রাকাও কি চিনতে পারছে তাকে ? মুখ দেখে অবশ্য কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। এমন হতে পারে মেয়েটা খুব নিখুঁত অভিনয় জানে। হয়তো প্রথম থেকেই চিনেছে নন্দিতাকে। হয়তো ইচ্ছে করেই...। হতে পারে,হতেই পারে। নন্দিতার কি কোনও ছবিই নেই অরুণদের বাড়িতে ! আর কারও কাছে না থাক, অরুণের অ্যালবামে থেকে যেতে পারে এক আধটা। অরুণ কি আর নন্দিতার সব ছবিই ফেলে দিয়েছে ! এমনও হতে পারে রাস্তাঘাটে কোনও দিন দূর থেকে রাকাকে দেখিয়েছে। অরুণ, ওই দ্যাখো, ওই যে যাচ্ছে, ওটাই নন্দিতা ! নন্দিতা হয়তো দূরমনস্ক ছিল সে সময় ! অরুণ বা রাকাকে সে খেয়ালই করেনি !
রাকার সঙ্গে কোনওরকমে দু-একটা দায়সারা কথা বলে নন্দিতা বাথরুম যাওয়ার নাম করে উঠে গেল। শহরতলি ছাড়িয়ে এসে ধাবমান এসি এক্সপ্রেসের গতি এখন উদ্দাম। বিশাল প্রান্তরের মাঝখানে খোলা বাতাসের সঙ্গে এখন তার অসম লড়াই। পর্যুদস্ত বাতাস আছাড় খেয়ে পড়ছে বার বার। মাথা কুটে মরছে । সংকীর্ণ প্যাসেজটা ধরে, পর পর পরিপূর্ণ কুঠুরিগুলো পেরিয়ে টলমল পায়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল নন্দিতা  বাথরুমে এসেও কিছুতেই স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না । পায়ের তলার জমি থরথর কাঁপছে। টাল সামলাবার জন্য নন্দিতা বেসিনের পাশের রডটাকে আঁকড়ে ধরল। আয়নায় ক্রমাগত কেঁপে চলেছে আরেক নন্দিতা। কাঁপছে ? না হাসছে হিহি করে ?
—কীরে, বোকার মতো ঘাবড়ে গেলি কেন ?
—অরুণের বউ যদি আমাকে চিনে ফেলে ?
–ফেললে ফেলবে। তাতে তোর কী।
—আমার অস্বস্তি হচ্ছে।
—অস্বস্তি হওয়ার কোনও মানেই হয় না। ওই অসভ্য বুনো দানবটা কাকে বিয়ে করল না করল, সেই বউ তোকে চিনল কি চিনল না। তাতে কী এসে যায় ! তুই তো কোনওদিন কোনও অন্যায় করিসনি। ভয়টা কীসের ? —সেটা ঠিক কথা। আমার জীবনটা অরুণ অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। মারধোর, অত্যাচার, অন্যায় রকম গার্জেনগিরি...
—তবে ? সামলে নে নিজেকে। তোর এখন নিশ্চিন্ত জীবন, স্বামী, মেয়ে...
নন্দিতা মুখচোখে জল দিয়ে বেরিয়ে এল।
গোটা কম্পার্টমেন্টের লোকজন বৈকালিক আলস্য গায়ে শুয়ে বসে আছে এখন। ঝিমোচ্ছে। গল্প করছে। তাস খেলছে। একটা কুপে,অসংখ্য টিফিনবাক্স সাজিয়ে খেতে বসে গেছে এক অবাঙালি পরিবার। প্যাসেজের দিকের সিটে একটি মেয়ে উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে। নন্দিতাদের প্যাসেজের সিটের বয়স্ক ভদ্রলোক দুজন কী যেন গভীর আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। নন্দিতা শ্যামলেন্দুর সামনে গিয়ে দাঁড়াল,
—কীগো বই মুখে করে বসে থাকলেই হবে ? সেই কখন ভাত খেয়েছ। এগারোটার আগে। খিদে পায়নি ?
শ্যামলেন্দু বই বন্ধ করল, —হ্যাঁ দাও। কিছু খেতে-ফেতে দাও |
খাবার টুকরিটা ব্যাংক থেকে নামাতে নামাতে নন্দিতা এক পলক দেখে নিল রাকাকে । রিমলির সঙ্গে বকবক করে চলেছে মেয়েটা। নন্দিতা মেয়েকে বলল, —আয়। খেয়ে নে আগে ।
গুমগুম শব্দ তুলে কোনও এক স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম পিষে মাড়িয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ছুটন্ত ট্রেন। স্টেশনে দাঁড়ানো একটি লোকের মুখও পরিষ্কার বোঝার আগে সোজা এক সর্ষেক্ষেত্রে পৌছে গেছে। শেষ বিকেলের আলোয় হলুদ ফুলে লালচে আভা।
নন্দিতা বুঝতে পারছিল না রাকাকে কিছু খেতে বলার অনুরোধ করাটা উচিত হবে কি না। নতুন বিয়ে হওয়া ছেলেমেয়ে দুটোর সঙ্গেও তবে ভদ্রতা করতে হয়। ছেলেমেয়ে দুটো দুজন দু জানলার দিকে তাকিয়ে এখন। রাকার চোখও বাইরের হলুদ প্রান্তরের দিকে।
রিমলি একমুখ সন্দেশ নিয়ে সামনের ছেলেটির সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করল, —কাকু, ও কাকু তোমরাও কি কলকাতায় যাচ্ছ ? শ্যামলেন্দু বকল মেয়েকে, —ও কী ! মুখে খাবার নিয়ে কথা বলছ কেন ? কাকুর গায়ে পড়বে যে।
রিমলি সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব ওয়াটার বটল মুখে লাগিয়ে জল খেয়ে নিয়েছে, —এবার কথা বলি ?
রিমলির চোখ ঘোরানোর ভঙ্গি দেখে ছেলেমেয়ে দুটো হেসে কুটিপাটি। রাকা আর শ্যামলেন্দুও।
ছেলেটি কাছে টানল রিমলিকে, নাম কী গো তোমার ?
—রিমলি। না না, প্রজ্ঞাপারমিতা আচার্য।
—ওরেহ্ বাবা। তুমি স্কুলে পড়ো ?
—নিশ্চয়ই।
—কোন ক্লাস ?
নাসারি টু'। রিমলি উত্তর দিয়েই উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়েছে, —এটা বুঝি তোমার নতুন বউ ?
—কী করে বুঝলে ?
বারে, নতুন বিয়ে হলেই তো এতটা করে সিঁদূর পরে। আমার পিসিও পরত ।
মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠল, এখন বুঝি আর পরে না ? —কই আর পরে। বলতে বলতে রাকার দিকে হাত দেখাচ্ছে, —ওই আন্টিটার মতো পরে। সরু করে । একটু। নন্দিতা মেয়ের মাথায় চাঁটি মারল, —অনেক হয়েছে। এবার চুপ করো।
—আহা বলুক না । ছেলেমানুষই তো বলছে। রাকা হেসেই চলেছে, —এরকম কটকটি বাচ্চা আমার ভীষণ ভাল লাগে। আমার মেয়েটা আবার কথা বেশি বলে না। গুণ্ডামি করে । ভয়ানক গেছো । অরুণের মেয়ে হল কবে ? এ খবরটা তো জানা ছিল না। অবশ্য জানার উপায়ও নেই আর। সুমিতাটা বিয়ে করে সেই ব্যাঙ্গালোর চলে গেছে। ওর কাছ থেকেই অনেক খবরাখবর পাওয়া যেত অরুণের । নন্দিতার দৃষ্টি স্থির হল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। রাকা কি মেয়ের খবর ইচ্ছে করেই শোনাল তাকে ! না শুধুই কথার কথা !
মুখ ফসকে নন্দিতা জিজ্ঞাসা করে ফেলল,
—কত বড় মেয়ে আপনার ?
—এর থেকে বড়। পাঁচ পুরে এবার ছয়ে পড়বে। এই নভেম্বরে । তবু এখনও এত... নন্দিতা দ্রুত হিসেব করে নিচ্ছিল। ডিভোর্স হওয়ার পর পরই বিয়ে করেছিল অরুণ । মানে বছর সাতেক আগে। রাকা বলছে রাকার মেয়ে ছয় হয়ে যাবে। তার মানে এবার আর বিয়ের পর তর সয়নি অরুণের। অথচ তাদের বিয়ের পর নন্দিতার কোনও কথাতেই অরুণ কান দেয়নি, —এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা হলে লাইফের আর রইল কী ?
–কেন ? যাদের বাচ্চা হয় তাদের বুঝি লাইফ থাকে না ?
—বাজে বোকো না তো। এখন তো ফুর্তি করার সময়। তা না, এখন থেকেই চ্যাঁ ভ্যাঁ, আমূলস্প্রে, গ্রাইপওয়াটার...। তাছাড়া বাচ্চাহলে মেয়েদের ফিগার নষ্ট হয়ে যায়।
—আমি ফিগার নিয়ে মাথা ঘামাই না।
—আমি ঘামাই। লোকে কী বলবে ?
অরুণের বউটা একটা কুমড়ো পটাশ,হ্যাহ। আমার বউ হবে দেখবার মতো। বুক ফুলিয়ে দেখাব সকলকে।
বউ কি দেখানোর জিনিস ?
—তাছাড়া কী। সবসময় সেজেগুজে টিপটপ থাকবে।
অরুণ ছিল ওইরকমই। সারা দিন ধরে শুধু উদ্দামতা, আমোদ প্রমোদ, বিলাসিতা । বন্ধুবান্ধব আর খেলার মাঠ নিয়ে বুদ হয়ে থাকা। নিয়ম করে সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠেই মাঠে দৌড়ত। প্র্যাকটিস্ থেকে ফিরেই স্নান খাওয়া সেরে অফিস। খেলা থাকলে অফিস থেকে মাঠ সেরে একরাশ বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাড়ি ফিরত। তারপর সন্ধে থেকে রাত অবধি তাদের আসর। খেলা যেদিন থাকত না সেদিন বাইরে আড্ডা মেরে ফিরতে ফিরতে রাত দশটা। সেসব দিন মুখে আবার হাল্কা মদের গন্ধ। সব কিছুর পর রাত্রে আরেক প্রস্থ ভালবাসার খেলা । সেই খেলায় নন্দিতার কোনও আলাদা ভূমিকা থাকতে পারবে না। ইচ্ছে অনিচ্ছে থাকবে না। শুধু একপেশে নির্মম বাসনা মিটিয়ে যেতে হবে তাকে। মাগো, আর কিছুদিন অরুণের সঙ্গে থাকলে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মরেই যেত নন্দিতা। নন্দিতার বন্ধুরা বলত, —ইশ, কী দেখে যে তুই পছন্দ করেছিলি অরুণকে ? তোর সঙ্গে কোনও কিছুতেই তো মিল নেই। না শিক্ষা, না রুচি...
নন্দিতা বোঝাতে পারত না ভালবাসার জোয়ার এলে শিক্ষা, রুচি, বিচারবিবেচনা সব খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। অরুণকে তো সত্যি সত্যি এক সময় ভালবেসেছিল নন্দিতা। অরুণের ঝড়ো আবেগ চুম্বকের মত টেনেছিল তাকে।
রাকার সঙ্গেও কি অরুণ বিছানায় সেই একই রকম আচরণ করে ?
পুরনো দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠতে নন্দিতা কুঁকড়ে গেল বিতৃষ্ণায় ।
হেমন্তের বিকেল দ্রুত মরে আসছে বাইরে। কামরার ভিতরেও বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসছে তরল অন্ধকার। জানলার দিকে পিছন ফিরে বসে থাকা রাকার মুখে সেই অন্ধকারের ছায়া। রাকা কি এখনও চিনতে পারেনি নন্দিতাকে ? বোধহয় না। স্বামীর আগের পক্ষের স্ত্রীর সঙ্গে কেউ কি এত সহজভাবে কথা বলতে পারে ?
কাগজের কাপে কফি বিক্রি করতে এসেছে একটা লোক । ছেলেমেয়ে দুটো কফি। খাচ্ছে। শ্যামলেন্দু আবার ডুবে গেছে বইয়ের পাতায়। লোকটা সারাক্ষণ বই মুখে করে বসে থাকতে কী ভালই না বাসে। বাড়িতেও সারাক্ষণ মোটা মোটা বই। সংসারের কোনও খোঁজখবরই রাখে না। সংসার তো দূরের কথা, মেয়ে বউয়েরও না। নন্দিতার এক এক সময় মনে হয় সে বা রিমলি যদি সাত দিন বাড়িতে নাও থাকে, সেটাও বোধ হয় টের পাবে না শ্যামলেন্দু।
নন্দিতা রাকাকে জিজ্ঞাসা করল, কফি খাবেন ? রাকা মাথা নাড়ল, ও তো চিনি দেওয়া কফি।
—আপনি বুঝি চিনি খান না ?
—খুব কম। বড়্ড মোটা হয়ে যাচ্ছি। নন্দিতা হেসে ফেলল, —কোথায় মোটা ! বলতে বলতে চোখ নাচল, —কত ? ওজন কত ?
—ছাপ্পান্ন কেজি। তাতেই আমার বর আর দেওররা যা খ্যাপায়।
কথাটা ঠং করে বাজল নন্দিতার কানে। বউ সম্পর্কে স্লিম স্লিম বাতিক এখনও তবে যায়নি অরুণের। এই বউ নিয়ে আদিখ্যেতাও নিশ্চয়ই অনেক বেশি। তার মতো তো আর মাজা গায়ের রঙ নয়, নাক চোখও অনেক তীক্ষ্ণ, ফিগারটাও। ভাবতে গিয়ে বুকের ভিতর আচমকা একটা পিঁপড়ের কামড় অনুভব করছিল নন্দিতা। সুন্দরী বউ পেয়ে অরুণ তা হলে সুখেই আছে। তার উপর এমন স্বামী সোহাগিনী বউ। স্বামীর আড়ালেও মোটা না হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেই গ্রাম্য দেওরগুলোও নিশ্চয়ই বৌদি বলতে অজ্ঞান এখন। তরুণ, বরুণ, প্রকাশ। সারা দিন ধরে তিনজন শুধু হাহা করে চিল্লোত, সকাল দুপুর বিকেল রাত্তির চারবেলা একগলা করে ভাত গিলে গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে যেত ফুটবল ক্রিকেট হকি যা হোক একটা কিছু নিয়ে, গোটা পাড়া মাত করে রাখত। এই শান্ত সভ্য মেয়েটা কী করে মিলেমিশে আছে তাদের সঙ্গে!
গাড়ির গতি ধীরে ধীরে কমে আসছে। দুপাশে এখন ঘন জনপদ। শ্যামলেন্দু বাইরের দিকে উঁকি দিল। ঘড়িও দেখল একবার, —টুণ্ডলা আসছে বোধ হয়।
নন্দিতা একটু স্বামীর গা ঘেঁষে বসল, এখানে ভাল রাবড়ি পাওয়া যায় না ?
শ্যামলেন্দু আড়মোড়া ভাঙল, সে ইটাওয়াতে ভাল পাওয়া যায় ।
—স্টেশন এলে একবার নেমে দ্যাখো না বাবা। আর আমাকে উপরের ব্যাগটা একটু নামিয়ে দাও। দুটো মাফলার বার করব ।
—তেমন তো একটা ঠাণ্ডা নেই।
—তা হোক। একটুতেই তোমার আর তোমার মেয়ের যা গলা ফুলে যায়।
শ্যামলেন্দু কথা বাড়াল না। এসব ক্ষেত্রে সে কথা বাড়ায়ও না। সংসারের ব্যাপারে কিংবা শ্যামলেন্দু রিমলির, নন্দিতার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত । সিমলা থেকে কেনা দুটো নতুন মাফলার কিটব্যাগ থেকে বার করল নন্দিতা। সঙ্গে একটা পাতলা চাদরও। রিমলি যে-কোনও মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। তখন লাগবে । টুণ্ডলাতে ট্রেন থামতেই শ্যামলেন্দু ব্যস্তসমস্ত হয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেল ।
রাকা জিজ্ঞাসা করল, আপনার স্বামী খুব কম কথা বলেন, তাই না ?
—ভীঈঈষণ। শব্দটা উচ্চারণের সময় হঠাৎই এক ধরনের অহংকার ফুটে উঠল নন্দিতার গলায়, —ওর স্টুডেন্টরা বলে স্যর নিজেই নাকি একটা জ্যান্ত বই। বইয়ের মতোই নিঃশব্দ কিন্তু....
—উনি কলেজে পড়ান ?
—আগে পড়াত। আমি যে কলেজে পড়াই সেখানে। এখন ইউনিভার্সিটিতে চলে গেছে। পড়াশুনো ছাড়া পৃথিবীর কিছুই বোঝে না। নিজের কানেই নিজের কথাগুলো সুর হয়ে যাচ্ছিল নন্দিতার। সে কি রাকাকে শোনাতে চাইছে কথাগুলো ? না নিজেকেই শোনাতে চাইছে অরুণের চেয়ে অনেক বেশি গুণী, মার্জিত এক প্রকৃত শিক্ষিত মানুষের সঙ্গে ঘর করে সে এখন ?
শ্যামলেন্দু কোলাহল ঠেলে, ভিড় পেরিয়ে, রাবড়ির ভাঁড় হাতে নিয়ে ফিরে আসছে। সঙ্গে কয়েকটা শালপাতার ঠোঙা।
রিমলি দেখেই লাফিয়ে উঠল, —আমি খাব। আমি খাব। আমাকে দাও।
নন্দিতার ভুরু কুঁচকে গেল। এরকম আদেখলেপনা তার একদম পছন্দ নয়। তাছাড়া রাকার সামনে...। নন্দিতা গম্ভীর মুখে বলল, —অসভ্যতা করো না। তোমায় ঠিক দেওয়া হবে। তবে তুমি আর এর পর জানলার ধারে বসবে না। ট্রেন ছাড়লেই গলায় মাফলার জড়াবে।
—না আমি জানলার ধারে বসব।
—না বসবে না।
রাকা রিমলিকে ভোলাতে চাইল, —তুমি জানলার ধারে বসতে চাও, তাই তো? ঠিক আছে, তুমি এদিকে এসে বোসো, আমি ও পাশে যাচ্ছি। তোমার মায়ের পাশে। জানলার ধারেও বসা হবে, হাওয়াও লাগবে না। খুশি ? নন্দিতা বিরক্ত হল। বেশ তো উল্টোদিকে বসেছিল, পাশে কেন এসে বসতে চায় !

-দুই-

—আপনি কি খুব হৈ-হুল্লোড় বন্ধুবান্ধব ভালবাসেন ?
—উহু। না তো।
–গঙ্গার ধারে বেড়াতে গিয়ে শুধু ফুচকা আলুকাবলি ভেলপুরি খেয়েই চলে আসেন ?
—না। একদমই না।
—হঠাৎ হঠাৎ ক্যানিং ডায়মন্ডহারবার বেড়াতে যেতে কেমন লাগে আপনার ?
—এটা ভাল লাগবে। যদিও যাইনি কখনও।
—একা একা বৃষ্টিতে ভিজতে কেমন লাগে ?
—দারুণ।
রাকাকে একের পর এক প্রশ্ন করতে করতে নিজের প্রশ্নগুলো নিজেই উপভোগ করছিল নন্দিতা। রাকা বুঝতেও পারছে না তার স্বামীর প্রতিটি পছন্দ অপছন্দ এখনও মুখস্থ আছে নন্দিতার। বিয়ের পর প্রথম প্রথম, হঠাৎ কোনও লক্ষ্য ছাড়াই নন্দিতাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ত অরুণ। শেয়ালদা থেকে ট্রেনে উঠে ক্যানিং কিংবা ডায়মণ্ডহারবার। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে অরুণ নিজের মনেই বেসুরো গলায় গান ধরত। একবার বাসন্তী যাওয়ার পথে ভুটভুটিতে উঠে খুশিতে চুমুই খেয়ে ফেলতে যাচ্ছিল নন্দিতাকে। লোকজন সব হাঁ করে দেখছে, অরুণের ভুক্ষেপ পর্যন্ত নেই—আমার বউকে আমি আদর করব, কার বাবার তাতে কী ? ফেরার পথে সেবার ক্যানিংয়ের মাছের আড়ত থেকে এক গাদা চিংড়ি কিনে ফেলল। সেই চিংড়ি সেই রাতেই রান্না করে খেতে হল বাড়ির সবাইকে। সব সময় লাফাচ্ছে, ঝাঁপাচ্ছে, হৈ হৈ চিৎকার করে যাচ্ছে। একবার ডায়মণ্ডহারবারে নদীর ধার ধরে দৌড়তে দৌড়তে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল ভাঙা লাইটহাউসটার আড়ালে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য একইভাবে দৌড়তে দৌড়তে ফিরে এল—দেখেছ তো, একটুও দম কমেনি। বন্ধুরা বলে আমি নাকি হাফটাইমের প্লেয়ার হয়ে যাচ্ছি।
সেই লোকটার সঙ্গে এই মেয়েটার মেলে কীভাবে !
নন্দিতা আবারও জেরা করল। রাকাকে,—আপনি কি হিন্দি সিনেমা দেখতে ভালবাসেন ? মানে বাজারে যেসব মারপিট নাচাগানার ছবি চলে আর কি !
—খুব একটা বাসি না। দেখি মাঝে মাঝে।
—মোগলাই খানা খেতে কেমন লাগে। আপনার ?
—খারাপ লাগে না। কিন্তু আপনি আমাকে এসব প্রশ্ন কেন করছেন বলুন তো ?
নন্দিতা উত্তরটা এড়িয়ে গেল। পাশে রাখা অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের প্যাকেট ফাঁক করে রাতের খাবারটা দেখে নিল একবার। ট্রেনের খাবার তার এমনিতেই ভাল লাগে না, আজ তো আরও ইচ্ছে করছে না খেতে। শ্যামলেন্দু খাওয়া শেষ করে আপার বার্থের বিছানায় উঠে গেছে। আজই বোধহয় পেপারব্যাকটা শেষ না করে ছাড়বে না। সন্ধে নামার মুখে মুখে রিমলি একটু ঘুমিয়ে নিয়েছিল, এখন আর দশটার আগে তার চোখে ঘুম আসবে না। পাশের কুপে,তিন চারটে ছেলে তাস খেলছে, রিমলি তাদের পাশে গিয়ে বসে আছে। বেড়িয়ে ফেরা এক দল, ছেলের তাস খেলার এখন মুগ্ধ দর্শক সে। ছেলেগুলো খেলার থেকে হৈ হল্লাতেই বেশি আগ্রহী। মাঝে মাঝেই হিন্দি গানের কলি গেয়ে উঠছে দু একজন। নন্দিতাদের কুপের ছেলেমেয়ে দুটো নিচু গলায় কথা বলতে বলতে ফিক ফিক করে হাসছে।
রাকা মোড়ক খুলে রুটি বার করল—বললেন না তো ওসব প্রশ্ন করলেন কেন ? নন্দিতা আলতো হাসল, ট্রেনে আলাপ হল, বন্ধুত্ব হল, বন্ধুর কী ভাল লাগে না লাগে জানতে, নেই ? রাকার মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় সে নন্দিতার কথা বিশ্বাস করেনি। বিশ্বাস করানোর দায়ও নেই নন্দিতার। তার শুধু অবাক লাগছে, মেয়েটা তাকে দেখে একদমই চিনতে পারল না। আশ্চর্য ! নন্দিতার তবে আর একটা ছবিও নেই অরুণদের বাড়িতে ! ও বাড়ি ছাড়ার সময় নন্দিতা তার বেশির ভাগ ছবিই নিয়ে এসেছিল। হানিমুনের ছবিগুলোও। তবু একটাও কি... ! অরুণ তাকে তবে পুরোপুরি মুছে ফেলেছে জীবন থেকে ! কোনও স্মৃতি | চিহ্নই রাখেনি !
নন্দিতার বুকটা টনটন করে উঠল। খাবারগুলো আরও বিস্বাদ এই মুহুর্তে।
রাকা জিজ্ঞাসা করল, আপনাদের কি জয়েন্ট ফ্যামিলি ?
—নাহ। বিশাল লম্বা একটা নিশ্বাস গড়িয়ে এল নন্দিতার বুক থেকে—আমার শ্বশুরবাড়ি নর্থবেঙ্গলে। কুচবিহার । ওখানে সবাই আছেন। শ্বশুর শাশুড়ি ভাশুর।
—কলকাতায় ভাড়া থাকেন ?
—আগে থাকতাম। রিসেন্টলি আমরা একটা ফ্ল্যাট কিনেছি।
—আপনারা দুজনে বেরিয়ে যান, মেয়েকে নিয়ে প্রবলেম হয় না ?
—সে তো একটু হয়ই। একটা রাতদিনের বিশ্বাসী লোক আছে, এই যা।
রাকা বলল—আমার অবশ্য সেদিক দিয়ে খুব সুবিধে। বাড়িতে শাশুড়ি আছেন, দেওর জা। আমি অফিস গেলেও মেয়ে কখনও একা হয় না।
—আপনি চাকরি করেন ! নন্দিতা বিস্ময়ে হতবাক।
—করি। ব্যাঙ্কে। আমার কর্তার ব্রাঞ্চে | একটা ভয়ানক হিংস্র রাগ গুমরে উঠছিল নন্দিতার বুকের গভীরে। সে কলেজে চাকরির অ্যাপ্লিকেশন করছে শুনেই মুখ হাঁড়ি হয়ে গিয়েছিল অরুণের মার। অরুণ রাগে ফেটে পড়েছিল,—আমার বউ চাকরি করতে যাবে ? কভি নেহি।
নন্দিতা যুক্তি দেখিয়েছিল—ভেবে দ্যাখো, দুজনে চাকরি করলে কত সুবিধে হবে। এত বড় একটা সংসার...তোমার একার উপর বেশি। চাপ পড়ে যায়।
–তোমার পয়সায় আমি সংসার চালাব ?
—চললে ক্ষতি কী। কত ভালভাবে থাকা যাবে বলো তো। যেখানে খুশি বেড়াতে যেতে পারব, পছন্দসই জিনিস কিনব...
—কী পছন্দ মতন জিনিস তুমি পাও না শুনি ? এই তো সেদিন দেড়হাজার টাকা দামের একটা শাড়ি কিনে দিলাম। আসলে চাকরিটা ছুতো, তুমি এখন উড়তে চাইছ।
—মূর্খের মতো কথা বোলো না তো।
—মূর্খ জেনেই তো বিয়ে করেছিলে আমাকে। এই মূর্খের প্রেমেই হাবুডুবু খেয়ে তেজ দেখিয়ে বেরিয়ে এসেছ বাড়ি থেকে।
—আমি ওভাবে কিছু বলতে চাইনি। তুমি মিছিমিছি জট পাকাচ্ছ।
—সব কথা মুখে বলে বোঝাতে হয় না। হাবভাবে বোঝা যায় ।
মূর্খেতোমার মনটা এত নিচু ?
রাগে, দুঃখে, অপমানে তিন দিন অরুণের সঙ্গে কথা বলেনি নন্দিতা। অরুণ নরম হয়নি এতটুকু। সেই লোক নিজের অফিসের মেয়েকে বিয়ে করে দিব্যি সুখে ঘর করছে ? কবে থেকে ভালবাসা চলছিল রাকার সঙ্গে ? নন্দিতার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার আগে থেকেই কি ? সেই কারণেই কি নন্দিতার সঙ্গে... ?
নিজের অজ্ঞাতে গলায় ঝাঁঝ ফুটল নন্দিতার—বিয়ের অনেক আগে থেকেই আপনাদের তবে আলাপ বলুন ?
—উহু। রাকা হাসছে ঠোঁট টিপে—আমি আগে একটা অন্য ব্রাঞ্চে ছিলাম, এই ব্রাঞ্চে বদলি হয়ে আসার পরও সেরকম প্রেমটেম কোনওদিনই হয়নি। কলিগরাই প্ল্যান করে... ও। তার মানে অরুণের দুর্ভাগ্যে কাতর সহকর্মীরাই ব্যাপারটা ঘটিয়েছে। কিন্তু সুমিতা কেন নন্দিতাকে বলেনি রাকা চাকরি করে ? নন্দিতার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেবে না বলে ? হয়তো তাই।
নন্দিতার বুকে ঢেউ ভাঙছিল ক্রমাগত । রাকার বেলায় চাকরি করা নিয়ে আপত্তি নেই। অরুণের অরুণের মাও দিব্যি মেনে নিয়েছেন ব্যাপারটা। খুশি মনে রাকার মেয়েকে সামলান দিনভর। এ চেতনাটা যদি ওদের আগে আসত !
নন্দিতাকে এখন কলেজে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে ভাবতে হয় রিমলি কী করছে, কী খাচ্ছে, স্কুল থেকে ঠিকমতো ফিরেছে তো। একটা যদি দেওর ননদও থাকত নন্দিতার ! না হয় তারা তরুণ বরুণদের মতোই হত।
নন্দিতার সংসারটা বড় বেশি ফাঁকা ফাঁকা।
রাকা জানলার কাচ নামিয়ে দিয়েছিল, নন্দিতা সেটা তুলে প্রায় ভর্তি অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলটা ছুঁড়ে দিল বাইরে। পলকে এক ঝলক দমকা বাতাস ঝাঁপিয়ে পড়েছে গায়ের উপর। নন্দিতা জানলাটা বন্ধ করে দিল। বেসিনে হাত ধোওয়ার জন্য যেতে গিয়ে রিমলির উপর চড়াও হল, কী রে, তুই ঘুমোবি না ?
—দ্যাখো না, এই কাকুটা আমাকে কিছুতেই যেতে দিচ্ছে না।
ছেলেগুলো হেসে উঠল। একজন বলল, এই মিষ্টি মেয়েটা হাত ছোঁয়ালেই যা দারুণ দারুণ তাস উঠছে না বৌদি।
আরেকজন বলল, বসুন না বৌদি।
তাসখেলা নন্দিতার দু'চক্ষের বিষ।
ছেলেগুলোর আহ্বাদেপনা মোটেই পছন্দ হল না তার,—নটা বেজে গেছে। রিমলি,এবার। ঘুমোবে চলো।
রিমলিকে বাথরুম-টাথরুম করিয়ে নিয়ে এসে। নন্দিতা দেখল শ্যামলেন্দু নীচে নেমে সিগারেট ধরিয়েছে। কী সব কথা বলছে রাকার সঙ্গে।
নন্দিতার শরীরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। কী আলোচনা হচ্ছে দুজনের !
রাকা নন্দিতাকে দেখে বলল, আমার এক জামাইবাবু ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে আছেন, ওঁকে জিজ্ঞেস করছিলাম চেনেন কি না।
নন্দিতা শ্যামলেন্দুর দিকে তাকাল, তুমি নেমে এলে যে ? বই শেষ ?
শ্যামলেন্দু ঠোঁট ওল্টাল, আলোটা বড় কম। চোখে লাগছে। নন্দিতাদের শোওয়ার তোড়জোড় দেখে নতুন বর-বউ দু’জন ঈষৎ সন্ত্রস্ত। রাকাও যদি শুয়ে পড়তে চায় তাদের উঠে যেতে হবে নিজেদের বার্থে। দুজনেরই মনে হয় বেশ অনিচ্ছা তাতে |
শ্যামলেন্দুর সঙ্গে বিয়ের পর প্রথমবার বেড়িয়ে ফেরার সময় দারুণ ভিড় ট্রেনে উঠতে হয়েছিল। আগ্রা থেকে। ট্রেনে উঠেই উশখুশ করছিল শ্যামলেন্দু। নন্দিতার মনে হয়েছিল একটু বোধহয় পাশে আসতে চাইছে মানুষটা । ওমা, প্রথম সুযোগেই একটা বাঙ্ক খালি পেয়ে সটান শুয়ে পড়ল তাতে । নীচে সারা রাত ঠায় বসে নন্দিতা। পরে বুঝেছে ওই উদাসীন মানুষটার পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক আচরণ। নাহলে ওভাবে কোনও মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় কেউ ! পরীক্ষার হলে গার্ড দিতে দিতে !
ডিভোর্সের পর বাপের বাড়িতে থাকাটা তখন প্রায় অসহ্য হয়ে উঠেছে নন্দিতার । দাদাবৌদির সঙ্গে সম্পর্ক তিক্ততম পর্যায়ে।
একবার বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েদের জন্য বাপের বাড়ির চৌকাঠ যে কত উঁচু হয়ে যায়, প্রতি পলে তখন নন্দিতা টের পাচ্ছে। একলা থাকার জন্য একটা বাড়ি বা হোস্টেল খুঁজে খুঁজে হন্যে। কিন্তু একা মেয়েকে কে দেয় বাড়ি ? পেয়িংগেস্ট থাকতে চাইলেও সহস্র জেরার মুখোমুখি হতে হয়। লেডিজ হোস্টেলের সংখ্যা বড়ই অপ্রতুল। এমন একটা সময়ে, চিন্তায় চিন্তায় পাগল নন্দিতা পরীক্ষার হল-এ শ্যামলেন্দুর গলা শুনেছিল, ম্যাডামকে খুব ডিপ্রেসড লাগছে যেন ?
নন্দিতা উত্তেজনার মাথায় বলে ফেলেছিল—একটা বাড়ি খুঁজে দিতে পারেন ? হোস্টেল-ফোস্টেল ?
—কার জন্য ?
আমার জন্য। বাড়িতে ভীষণ প্রবলেম হচ্ছে । দাদা বৌদি..বলতে গিয়ে নন্দিতার সম্বিৎ ফিরেছিল, না,মানে,ওদের একটু অসুবিধে...
শ্যামলেন্দু চিন্তিত মুখে উঠে গিয়েছিল চেয়ার থেকে। গোটা হল-এ বার কয়েক চক্কর মেরে পাশে এসেছে—আপনি আমার ফ্ল্যাট শেয়ার করতে পারেন। আমার এক্সট্রা ঘরও আছে। একা থাকি।
নন্দিতা স্তম্ভিত। লোকটা কি পাগল ? না বদমাইশ ? ডিভোর্সি মেয়েদের অনেক রকম অশোভন প্রস্তাব শুনতে হয় অনেক সময়, তা বলে শ্যামলেন্দু বলবে ? যার কিনা সভ্য ভদ্র মার্জিত পণ্ডিত বলে এত সুনাম কলেজে ? যাকে একটু আগেও শ্রদ্ধার চোখে দেখেছে। নন্দিতা ?
—আপনি কী বলছেন, আপনি জানেন ?
—জানি। জানি বলেই বলছি। আপনার মানসিক অসুবিধে না থাকলে আমরা বিয়েও করে নিতে পারি।
নন্দিতা দপ করে জ্বলে উঠেছিল—আপনার সঙ্গে কথা বলতে যাওয়াটাই ভুল হয়েছে ।
দুদিন পরে করিডোরে তাকে একা পেয়ে আবার শ্যামলেন্দু বলেছিল, আমার প্রপোজালটা ভেবে দেখেছ ?
নন্দিতার চোয়াল কঠিন। আপনি থেকে সোজাসুজি তুমি ! একবার মনে হয়েছিল যাচ্ছেতাই ভাবে অপমান করে দেয়। কিন্তু শ্যামলেন্দুর মধ্যে এমন এক ব্যক্তিত্ব আছে যা খারাপ মনে হলেও খারাপ ভাবা যায় না তাকে। শ্যামলেন্দু আবার ধরেছে তাকে কী হল ? ভেবেছ ?
—না সময় পাইনি। নন্দিতা একবার ভেবেছিল প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ করে শ্যামলেন্দুর নামে। অন্যান্য সহকর্মীদের কাছে শ্যামলেন্দুর মুখোশটা খুলে দেওয়ার কথাও ভেবেছিল একবার। কিছুই করতে পারেনি। নিজের সঙ্গে একা হলেই ওই শান্ত সৌম্য মিতভাষী শ্যামলেন্দু ভেসে উঠছে মনের পর্দায়। কেন যেন মনে হয়েছে ওই মানুষটাকে বিশ্বাস করা যায় । তবুও দিনের পর দিন তাকে প্রত্যাখ্যান করে গেছে নন্দিতা। শ্যামলেন্দুও হাল ছাড়েনি। শেষে মরিয়া হয়ে নন্দিতা একদিন বলে ফেলেছে,—ভাল না বেসে শুধু ঘর শেয়ার করার জন্য একজন আরেকজনকে বিয়ে করতে পারে ?
শ্যামলেন্দু বিকারহীন—আমি কি একবারও বলেছি আমি তোমাকে ভালবাসি না ? তবু মুখ ফুটে বলেনি আমি তোমাকে ভালবাসি। আমি তোমাকে চাই। তোমাকে ছাড়া চাঁদ তারা ফুল পৃথিবী সব বৃথা।
নন্দিতা প্রশ্ন ছুঁড়েছিল। আমার পাস্ট লাইফ সম্পর্কে কিছু জানেন আপনি ?
—না জানার কী আছে। এ কলেজের প্রতিটি ইট কাঠ জানে। তোমার একটা ফুটবলার স্বামী ছিল, সে তোমাকে কিক মেরে গোল পোস্টের বাইরে বের করে দিয়েছে। তার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক ?
—কেন ঝগড়া হয়েছিল জানেন ?
—অনুমান করতে পারি। নিশ্চয়ই বনেনি ।
—আপনার সঙ্গেই যে বনবে তার নিশ্চয়তা কী ?
—ট্রাই করতে দোষ কী। ইউ ক্যান স্টার্ট অ্যাফ্রেশ। নন্দিতার মুখ থেকে দুম করে। বেরিয়ে গেছে, আমার কিছু শর্ত আছে।
—জানি। তুমি তোমার মতো থাকবে। আমি আমার মতো। কেউ কারুর ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় মাথা গলাব না। তাই তো ?
নন্দিতা কেঁদে ফেলেছিল। হৃৎপিণ্ড লাফাতে শুরু করেছিল বেয়াড়াভাবে।
শ্যামলেন্দু কথা রেখেছে অক্ষরে অক্ষরে । তবে কেন যে নন্দিতার মনে হয় শ্যামলেন্দু যদি একটু জোর করেই ঢুকে পড়ত তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছায়, বেশি ভাল লাগত তার !
শ্যামলেন্দু টয়লেট থেকে রাত্রে পরার পাজামা। পাঞ্জাবি পরে চলে এসেছে। সাদা পোশাকে রোগা লম্বাটে চেহারাটা আরও গুরুগম্ভীর । চোখে হাই পাওয়ারের চশমা, চওড়া কপালে ঝকঝকে তামাটে মুখ। নন্দিতার হাতে তোয়ালে ফেরত দিয়ে তরতর করে উঠে গেল উপরের বার্থে—আর কিন্তু আমাকে ডাকবে না। এক্কেবারে ভোরে উঠব। এগারোটা সাড়ে এগারোটায় কানপুর আসবে, তখন যদি চা খাওয়ার ইচ্ছে হয় কাচ তুলবে, চাঅলাকে ডাকবে। আমাকে নয়।
নন্দিতা জিজ্ঞাসা করল, এয়ার পিলো নিয়েছ ?
—এয়ার পিলোতে আমার ঘুম হয় না। চাদর মুড়িয়ে বালিশ করে নিচ্ছি।
রিমলি নন্দিতার কোলের কাছে ঘুমিয়ে কাদা। জোর করে একবার শোয়াতে পারলে ঘুম আসতে দেরি হয় না মেয়ের।
নন্দিতা রাকাকে বলল—এই হচ্ছে মেয়ে। এই হচ্ছে বাবা। পুরো কুম্ভকর্ণ ফ্যামিলি।
রাকা হাসল, যাই বলুন, আপনার হাজব্যাণ্ড কিন্তু দারুণ হ্যাণ্ডসাম। কথাটা শুনতে ভাল লাগলেও নন্দিতা তেমন খুশি হতে পারল না। অরুণ অনেক বেশি ম্যানলি ছিল।

-তিন-
কৃষ্ণপক্ষে গাছপালা ক্ষেতনদী সব কিছুর উপর এক ছায়ার আস্তরণ দেখতে পায় নন্দিতা ।। চাঁদের আলো থাকলেও জ্যোৎস্নার মায়াবী আনন্দ যেন হাল্কা কালো পর্দায় ঢেকে রেখেছে কোনও অদৃশ্য জাদুকর। আঁধারমাখা কাঁচের মধ্যে দিয়ে দূরের এক আধটা বাড়ির টিমটিম আলো হঠাৎ হঠাৎ মাটির বকে তারার মতো ফুটে উঠেই মিলিয়ে যাচ্ছে। তারপর কাচের গায়ে শুধুই নিজের মুখের আবছা প্রতিচ্ছবি। ঘুমন্ত কামরার মৃদু আলোয় নিজের সেই প্রতিচ্ছবিকেও কেমন অলৌকিক মনে হচ্ছিল নন্দিতার। রহস্যময়। কে সে ! কী চেয়েছিল এত দিন ধরে ! এখন কী চায় ! কেন ওই  সামনে শুয়ে থাকা মেয়েটাকে দেখে এত চঞ্চল হয়ে পড়েছে সে ! তবে কি...!
রাকা পাশ ফিরল সামান্য। বন্ধ চোখ খুলেছে, ঘুমোবেন না ?
–ট্রেনে আমার ঘুম আসে না। বসে বসেই ঢুলে নিই একটু।
—আমারও আসে না।
—তাহলে শুয়ে রয়েছেন কেন ? এদিকে এসে বসুন। গল্প করি ।
রাকার চোখ ছলছল করে উঠল,মেয়েটার কথা মনে পড়ছে। কতদিন দেখিনি মেয়েটাকে। মার অসুখ শুনে হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়লাম...
—কবে এসেছিলেন দিল্লিতে ?
—সেই ফাস্ট অক্টোবর স্টার্ট করেছিলাম। আজ একুশ।
—মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এলেই তো পারতেন।
মাথা খারাপ ? মেয়ের বাবা মেয়ে ছাড়া। একদিনও থাকতে পারে না। মেয়েও চোখে হারায় বাবাকে। মা’র জন্য অত কান্নাকাটি নেই। ছোট্ট থেকেই। রাকা ফোঁস করে শ্বাস ফেলল—শুধু তার বাবা কেন ? ঠাকুমা কাকারাও এমন ভাবে সারাদিন আগলে রাখে, ওদের ছেড়ে মেয়ে কোথাও গিয়ে থাকতেই পারে না।
নন্দিতা সন্তর্পণে ঠাট্টা ছুঁড়ল এবার—মেয়ের মাকে বুঝি তার বাবা চোখে হারান না ?
রাকা হেসে ফেলল, প্রথম প্রথম হারাত। মেয়ে হয়ে গেলে মায়েদের কি আর সে দর থাকে ?
রাকার স্বর বলছে রাকারও কোথাও একটা গোপন কষ্ট আছে। কী সেটা ? নন্দিতা খুব সাবধানে প্রশ্ন ভাঁজল, আপনার বর কেমন ? আমার বরের মতো গোমড়ামুখো ? না। হাসিখুশি ?
—মন ভাল থাকলে হাসিখুশি । মন বিগড়লে গোমড়া।
—আপনার সঙ্গে যখন প্রথম পরিচয় হয় তখন কেমন ছিলেন ?
—সব ছেলেই যেমন থাকে। খুব লাইভলি। রাকার গলা কি একটু কেঁপে গেল ? উত্তর দিতে একটু বেশি সময় নিল ? নৃন্দিতা ঠিক বুঝতে পারল না। সে জানতে চেষ্টা করছিল কত তাড়াতাড়ি তাকে ভুলেছে অরুণ। একেবারেই কি ভুলে গেছে ? এক সময় অরুণ যে তাকে সাংঘাতিক ভালবাসত তাতে তো কোনও সন্দেহই নেই। একটু পাশবিক, একটু উগ্র, এই যা। সেই অরুণ দিব্যি অন্য একটা মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছে, এ কথা কী করে বিশ্বাস করে নন্দিতা ? রাকা নির্ঘাত চেপে যাচ্ছে। হয়তো অরুণের বিষন্ন মুখটাই তাকে আকৃষ্ট করেছিল বেশি। হয়তো অরুণের অতীত যন্ত্রণাই পথ করে দিয়েছিল মসৃণ। প্রেমের। হয়তো কেন ? নিশ্চয়ই তাই। নিজের মনে অরুণের নতুন করে প্রেমে পড়ার যুক্তিগুলোকে সাজাতে পেরে এক ধরনের তৃপ্তি পাচ্ছিল নন্দিতা। শ্যামলেন্দু বলত, নন্দিতা যদি তাদের বিয়েটাকে ম্যারেজ অফ লাভ না বলতে পারে, ম্যারেজ অফ কনভিনিয়েন্স বলতে আপত্তি কী। নন্দিতা আর শ্যামলেন্দুর বিয়ের সংজ্ঞা যদি তাই-ই হয় রাকা অরুণের বিয়েটাকে কী বলা যায় ? ম্যারেজ আউট অফ সিমপ্যাথি ? না ম্যারেজ অফ ফিজিকাল নিড় ?
গুম গুম শব্দে ট্রেনটা একটা ব্রিজ পার হচ্ছে। নিশুত রাতে নদী পেরোনোর এই শব্দটা বড় বেশি প্রকট হয় ।
রাকা উঠে এসেছে নন্দিতার পাশে। গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে নিয়েছে।
নন্দিতারও শীত শীত করছিল। কোন্ অদেখা ফাঁকফোকর দিয়ে যে ছুরির ফলার মতো তীক্ষ্ণ বাতাস হানা দেয় রাতের ট্রেনে কে জানে ! রিমলিটাও ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে গেছে। নন্দিতা মেয়ের গায়ে কম্বল ঢেকে দিল ভাল করে।
অনেকক্ষণ পর কথা বলল, আপনার মেয়ের কোন্ স্কুল ?
—সাউথ পয়েন্ট। আপনার মেয়ে ?
আপাতত পাড়ার একটা নার্সারিতে। দেখি এরপর ওয়ানে কোথায় ভর্তি করা যায়।
আজকাল ভাল স্কুলে ভর্তি করার যা ঝামেলা।
ঝামেলা বলে ঝামেলা । আমার মেয়েকে যে কী করে...। অবশ্য সব হ্যাপা আমার কর্তাই সামলেছে। সেই রাত থেকে লাইন দিয়ে ফর্ম আনা, অফিস কামাই করে মেয়েকে পড়ানো... । কাকে সব ধরে-টরে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে...। মেয়েকে ভাল স্কুলে দেওয়ার জন্য তো ওর ঘুম চলে গেছিল।
নন্দিতার বুক ফাঁকা হয়ে গেল। রিমলির লেখাপড়া নিয়ে শ্যামলেন্দুর বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। কিছু বলতে গেলে হেসে উড়িয়ে দেয় নন্দিতাকে, কুচবিহারের অনামী স্কুল থেকে পাশ করে আমি যদি ইউনিভার্সিটির মাস্টারিতে পৌছতে পারি, আমার মেয়েও যে কোনও স্কুলে পড়ে যেখানে পৌছবার ঠিক পৌছবে। তুমি নিজেই বা কী এমন কনভেন্ট বা পাবলিক স্কুলে পড়েছিলে ?
নন্দিতা তর্ক করেও বোঝাতে পারে না সময় এখন অন্যরকম। ইদুরদৌড়ে নাম লেখাতে গেলে একটা দামি খাঁচার ভিতর ঢুকতে হয় আজকাল। বোধহয় কোনও সিগনালে ট্রেনের গতি সামান্য কমেছিল, আবার সশব্দে দৌড়তে শুরু করেছে এক্সপ্রেস। নানা ভঙ্গিতে বেজে উঠছে ধাতব ঝঙ্কার। নন্দিতার মনেও সেই ঝঙ্কারের প্রতিধ্বনি। প্রতিধ্বনি ? নাকি আর্তনাদ ? গলার কাছে একটা চোরা কষ্ট ডেলা বাঁধতে চাইছে বারবার। শ্যামলেন্দুই বা কম নিষ্ঠুর কীসে ! অরুণ তার ইচ্ছা অনিচ্ছা জাহির করত গলার জোরে । একবার সিনেমা যেতে রাজি হয়নি বলে নন্দিতার হাত মুচড়ে দিয়েছিল। আর শ্যামলেন্দুর ইচ্ছা অনিচ্ছা এতই সূক্ষ্ম যে নিকটতম সম্পর্কের মানুষজনও তার হদিস পায় না। যখন পায় তখন অজান্তেই ওই নিস্পৃহ মানুষটার ইচ্ছা অনিচ্ছার শিকার হয়ে যায়। এত দিন সেটা ভাল ভাবে বোঝার সুযোগ পায়নি নন্দিতা। আজ যেন হঠাৎই এই রাতের গাড়িতে বসে উত্তেজনাহীন, নিরীহস্বভাব শ্যামলেন্দুর নাড়ির ঠিকানা পেয়ে যাচ্ছে সে । এই তো এবারই যেমন। এবারই তো সমুদ্রে যেতে চেয়েছিল নন্দিতা। একটি বারও আপত্তি না জানিয়ে মেয়েকে শুধু পাহাড়ের গল্প শোনাতে শুরু করল শ্যামলেন্দু। সমুদ্রে যাওয়ার কথা উঠতেই মেয়েরও বায়না শুরু। সে বরফের পাহাড় দেখবেই। এখন নন্দিতা বুঝতে পারছে রিমলি নয়, শ্যামলেন্দুই পাহাড়ে যেতে চেয়েছিল। এমন অনেক নিষ্ঠুরতা থাকে যার বিরুদ্ধে চিৎকার করা যায় না, দেওয়ালে মাথা ঠোকা যায় না, কেবল একটা শীতল বন্ধ জানলার ধারে বসে,অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে, বুক চেরা কষ্ট নিয়ে জেগে থাকতে হয় সারা রাত। মাঝের বাঙ্কে শুয়ে নতুন বিয়ে হওয়া মেয়েটা ঘুমের ঘোরে এলোমেলো হাত বাড়াচ্ছে। যেন আঁকড়ে ধরতে চাইছে কাউকে। বিদ্রুপের হাসিতে নন্দিতার ঠেটি বেঁকে গেল।
রাকারও দৃশ্যটা নজরে পড়েছে। নন্দিতার কানে কানে বলল, আহারে, এক বাঙ্কে যদি শুতে পারত দুজনে।
নন্দিতার ঠোঁট থেকে বিদ্রুপ মুছে গিয়ে একটা অন্য ধরনের হাসি ফুটে উঠল, চান্স পেলে। সেভাবেও যায় অনেকে। আমিই গেছি।
রাকার চোখে অবিশ্বাস, যাহ।
নন্দিতা বলল, সত্যি। বম্বে যাওয়ার সময় প্যাসেজের দিকের বার্থ দুটো পেয়েছিলাম। গোটা রাত্তির ও একবারও উঠল না উপরে।
—তবে যে বলছিলেন উনি একটুও রোমান্টিক নন,আঁ ?
—সে তো কথার কথা। এক্কেবারে অন্য মানুষ ছিল সে সময়। বৃষ্টি পড়লে কিছুতেই আমাকে ছাতা খুলতে দেবে না। একই ছাতার নীচে দুজনকেই আধভেজা হতে হবে।
—ওমা তাই !
লজ্জার কথা কী আর বলব। নিজে হাতে শাডি গয়না পছন্দ করে কিনে আনত। এনেই হুকুম, শিগগির সব পরে এসো। দেখব তোমাকে । রাকা খিলখিল করে হেসে উঠল—সত্যি আপনার বর... !
নন্দিতা আরাম করে সিটে মাথা রাখল। হাসল চোখ বুজে। মনে মনে বলল,—সেটা আমার বর ছিল না রে,তোর বর।

-চার-
–চোলিকে পিছে কেয়া হ্যায়, চোলিকে। পিছে...
গানের কলিটা শুনেই পিত্তি জ্বলে উঠেছিল নন্দিতার। আড় চোখে দেখল রাকার ভুরুতেও ভাঁজ পড়েছে। শ্যামলেন্দু পাটনা থেকে কেনা ইংরেজি কাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে।
মোকামা স্টেশন থেকেই হা-রে-রে-রে করে উঠে পড়েছে ছেলেগুলো। তার আগে, পাটনা ছাড়ার পর থেকেই অবশ্য ট্রেনে বেশ ভিড়। দিনের বেলাতে এ সব ট্রেনে রিজার্ভেশনের কোনও বালাই থাকে না। কন্ডাক্টর গার্ড, চেকার-ফেকার সব উধাও। ঠেলেঠুলে যে যেখানে পারছে জায়গা করে নিচ্ছে এখন । নন্দিতা আর রাকাদের সিটে জনা পাঁচেক দেহাতি বুড়ি বসে পড়েছে গাদাগাদি করে । ছেলেগুলোও নন্দিতাদের কুপের সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে। -চুনরি কে নীচে কেয়া হ্যায়, চুনরি কে নীচে..রাকা নন্দিতা শ্যামলেন্দু তিনজনই পরিষ্কার বুঝতে পারছে কাকে উদ্দেশ্য করে এই অশালীন উচ্ছ্বাস। নতুন বিয়ে হওয়া মেয়েটিকে দেখে পুলক আর ধরে রাখতে পারছে না ছেলেগুলো । মেয়েটি মাথা নিচু করে একটা ম্যাগাজিন পড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটির চোখমুখ লাল। চোয়াল শক্ত।
রাকা নন্দিতার কানের কাছে ফিসফিস করে উঠল, এসব রাফিয়ানগুলোর জন্য লঙ ডিসটান্স ট্রাভেল করাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে আজকাল।
রিমলি হাঁ করে ছেলেগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে । নন্দিতা মেয়ের ঘাড় ধরে তার মুখ জানলার দিকে ঘুরিয়ে দিল । শ্যামলেন্দু এখনও ইংরেজি দৈনিকের আড়ালে।
নন্দিতা নিচু গলায় শ্যামলেন্দুকে বলল, পাশের কুপের ছেলেগুলোকে ডাকো না। কিংবা ওদিকের পাঞ্জাবি ভদ্রলোকদের।
লাভ হবে না। তার থেকে বরং ইগনোর করার চেষ্টা করো। কিউল-ফিউলে নেমে যাবে মনে হয়। মনে করো না মেট্রো চ্যানেলের গান শুনছ।
নন্দিতা চুপ করে গেল। জানে কথা বলে লাভও নেই। কলকাতার রাস্তাঘাটে হাঁটার সময়ে দু চারটে টিটকিরি যে তাকে শুনতে হয়নি তা নয়। শ্যামলেন্দু হয়তো তখন পাশেই তার । কখনও অপমানে নাকের পাটা ফুলে উঠলেও শ্যামলেন্দুর কোনও তাপ-উত্তাপ নেই, ঘরদোরে পোকামাকড় থাকে না ? । এগুলো হল রাস্তার পোকামাকড়। এদের টিকাটিপ্পনী গায়ে লাগাতে আছে ? ঝেড়ে ফেলে দাও। মশামাছি তাড়ানোর মতো। নন্দিতার বলতে ইচ্ছে করছে, পোকামাকড় লোকে ঝেড়ে ফ্যালে না, মেরে ফ্যালে। বলেনি। বললেও শ্যামলেন্দু গায়ে মাখত না। ঠিক আরেকটা কোনও বক্তৃতা দিয়ে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেত তার শান্তি প্রিয়, বিদ্বান স্বামী।
নন্দিতার মাথা ঝাঁঝাঁ করে উঠল। অত্যন্ত অভব্য ভঙ্গিতে ছেলেগুলোর মধ্যে একজন মাঝের সরু প্যাসেজটায় ঢুকে দাঁড়িয়েছে। কারণ ছাড়াই ঝুঁকে পড়ে জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্যাবলী দেখার চেষ্টা করছে। দেখতে
দেখতে মেয়েটির গায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে | পড়ল। মেয়েটি ভয়ে জড়োসড়ো।
মেয়েটির বর আর নীরবে থাকতে পারল না। ভুল হিন্দিতে বলে উঠল,—ঠিক সে দাঁড়ানে নেই সকতা কেয়া ?
সঙ্গে সঙ্গে বাকি ছেলেগুলো ভেংচে উঠেছে, কেয়া দাদা, ঠিক সে দাঁড়ানে নেই সকতা কেয়া ?
একজন বিহারি ভদ্রলোক পিছন থেকে বোধহয় শাসন করার চেষ্টা করলেন ছেলেগুলোকে।।
উত্তরে যুবকের দল অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছে।
মেয়েটি ভয়ে কেঁদে ফেলে প্রায় । তার থেকেও বেশি ভয় পেয়েছে রাকা। নন্দিতার ডানহাতের কজি চেপে ধরেছে প্রাণপণে । নন্দিতারও শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিমস্রোত ওঠানামা করছিল। বেশ বুঝতে পারছে সামনের ছেলেটি চিৎকার করে উঠতে চাইছে। সাহস পাচ্ছে না। আর কেউ যদি এগিয়ে না আসে, অতগুলো ছেলের সঙ্গে সে পেরে উঠবে কেন ? অক্ষম রাগে চোখমুখ তার দপদপ করছে। ট্রেনটার গতি ক্রমে ধীর হয়ে এল। গুড়গুড় আওয়াজ বাজিয়ে একটা ব্রিজে উঠে পড়েছে গাড়িটা। উদ্ধত ছেলেগুলো চেঁচিয়ে উঠল। সঙ্গীর উদ্দেশে, আরে ও শামা, ছোড় দে। দুলহানিয়াকো।
শ্যামলেন্দু নন্দিতার হাঁটুতে হাত রাখল—কিউল এসে গেছে। এবার সব নেমে যাবে। সত্যিই তাই। ট্রেন পুরোপুরি থামার আগেই ধাক্কাধাক্কি করে নেমে যাচ্ছে ছেলেগুলো। প্ল্যাটফর্মে নেমে জানলার ধারে এসে হাসির ফোয়ারা তুলল। ভাবটা এমন, কেমন মজা করলাম ? ভয় দেখালাম তোদের ?
ট্রেন ছাড়ার পর শ্যামলেন্দু নতুন করে খবরের কাগজে মন ডুবিয়েছে। যেন এতক্ষণ যা ঘটল তা কোনও স্বাভাবিক দৈনন্দিন ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়। যেন এতক্ষণ ছেলেগুলোর হল্লাবাজিতে শুধু শুধুই বিঘ্ন ঘটছিল তার পড়ায়। অথচ রিমলি যে রিমলি, সেও বেশ আহত হয়েছে ছেলেগুলোর বেলেল্লাপনায় ।
মেয়েটিকে সান্ত্বনা দেওয়ার সুরে বলছে,—তুমি মন খারাপ করো না আন্টি। দুষ্টু লোকগুলোকে বড় হলে আমি পুলিশে ধরিয়ে দেব।
ছেলেমেয়ে দুটো হাসার চেষ্টা করছে।
শ্যামলেন্দুর মুখেও মৃদু হাসি। নন্দিতার মাথা গরম হয়ে গেল । হঠাৎই ঝাঁঝিয়ে উঠেছে শ্যামলেন্দুকে, হাসবে না একদম। তখন ভয়ে চুপ করে থাকলে... শ্যামলেন্দুর মুখ থেকে হাসি মুছল না,—কী করতে পারতাম বলো। ওরা ওরকমই।
—পারবে না যখন, তখন হাসবেও না।
ছেলেটি নিজেকে ঠাণ্ডা করার জন্যই বোধহয় উঠে গেল সামনে থেকে। মেয়েটি চোখ বুজে হেলান দিয়েছে সিটে । রাকা অসম্ভব রকম চুপচাপ।
নন্দিতা রাকার মুখের দিকে তাকাতে পারছিল না। অরুণ থাকলে এতক্ষণে এই কামরায় যে একটা ‘খুনোখুনি’ কাণ্ড ঘটে যেত তাতে। কোনও সন্দেহই নেই। একবার ক্যানিং লোকালে দুটো ছেলে নন্দিতাকে চোখ মেরেছিল বলে সোজা গিয়ে দুহাতে দু’জনের কলার চেপে ধরেছিল অরুণ | কোনও প্রস্তুতির অবকাশ না দিয়ে প্রচণ্ড জোরে ঘুষি মেরেছিল একজনের চোয়ালে, লাথি চালিয়েছিল অন্যজনের পেটে। ছেলে দুটোও ছাড়ার পাত্র নয়। মুহুর্তে উল্টো আক্রমণ হেনেছে। অরুণও নাছোড়বান্দা। মারপিট করতে করতে নাক মুখ কেটে রক্ত ঝরেছে তবু অরুণকে ছাড়াতে পারেনি আর সব প্যাসেঞ্জাররা। অবিরাম চিৎকার করে যাচ্ছিল অরুণ, —মেয়েদের হিড়িক দেওয়া,অ্যাঁ ? শুয়োরের বাচ্চা,তোদের আমি চোখ উপড়ে নেব। লজ্জায় ট্রেনের দেওয়ালে মিলিয়ে যেতে ইচ্ছে করেছিল নন্দিতার । এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে শ্যামলেন্দুর জন্য ট্রেনের দেওয়াল খোঁজা উচিত। ভাগ্যিস রাকা তাকে চিনতে পারেনি। চিনলে ভাবত এক কাপুরুষ নপুংশককে বিয়ে করেছে তার স্বামীর আগের পক্ষের বউটা।
রাগুক, মারুক, ধরুক একটা চনমনে উত্তাপ ছিল অরুণের মধ্যে। শ্যামলেন্দু বড় বেশি শীতল। যান্ত্রিক। ভিতু ধরনের। পড়াশুনোর জগতে নিজেকে স্বেচ্ছাবন্দি করে যেন গোটা সাইবেরিয়া বুকের ভিতর পুরে রেখেছে লোকটা। রাকা বুঝি পড়ে ফেলেছে নন্দিতার মনের ভাবটাকে। নরম গলায় বলে উঠল,—ওঁর উপর অত রেগে যাচ্ছেন কেন ? সত্যিই তো উনি একা কীই বা করতে পারতেন ? দেখলেন না, এত ভদ্রলোক চারদিকে, কেউ জোর গলায় প্রোটেস্ট করল না।
নন্দিতার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, আপনার স্বামী থাকলে তিনি নিশ্চয়ই চুপ করে বসে থাকতেন না।
রাকা বলল,—কে জানে। ওর সঙ্গে থাকা অবস্থায় এরকম সিচুয়েশনে তো পড়িনি কোনওদিন ।
নন্দিতা মনে মনে বলল,—আমি পড়েছি । আমি জানি। অরুণ শ্যামলেন্দু নয়। অরুণের ভিতর প্রকৃত সাহস আছে। স্ত্রীর প্রতি প্রকৃত ভালবাসাও।
মন যে কী চায়, মন কি তা জানে !
এই যে সারাটা সকাল ধরে, সারাটা দুপুর ধরে শ্যামলেন্দুর সঙ্গে ভাল করে কথা বলতে ইচ্ছা করল না নন্দিতার, সারাক্ষণ ধরে শুধু অরুণের স্মৃতি রিনরিন করে বেজে চলল অন্তরে, বার বার মনে হল অরুণের সঙ্গে কোনও তুলনাই চলে না শ্যামলেন্দুর, অরুণ কম শিক্ষিত হয়েও অনেক বেশি সরল, সাহসী, সুন্দর, অনেক বেশি প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা সেই মনই সহসা কেন যে বিরূপ অরুণের উপর !
শ্রীরামপুর ছাড়িয়ে ট্রেনটা আরও এগিয়ে যাওয়ার পর রাকা নিজের মনেই বলে উঠেছিল,–এক ঘন্টার উপর লেট যাচ্ছে গাড়িটা। কে জানে কেউ স্টেশনে থাকবে কিনা।
মুহূর্তে নন্দিতার ভুরু' জড়ো,কার আসার কথা আছে ?
—আসার কথা তো আমার বরেরই।
শ্যামলেন্দু বলল,—চিন্তার কী আছে ? আমরা তো ভবানীপুরের উপর দিয়ে যাবই, তেমন হলে আপনাকে ...
নন্দিতা নিথর। অরুণ স্টেশনে আসতে পারে শুনেই আতঙ্কে শিথিল হয়ে আসছে তার শরীর। ওই লোকটার সামনাসামনি পড়তে হবে ! যে কিনা ঘাড় ধরে নন্দিতাকে বার করে দিয়েছিল বাড়ি থেকে। যে কিনা ডিভোর্সের। পর পরই নন্দিতাকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলে আরেকটা মেয়েকে নিয়ে সুখের সংসার পেতেছে !
রাকা বাথরুমের দিক যেতেই নন্দিতা হিসহিস করে উঠল,—ওর বর আসবে কি আসবে না সেটা ওর ব্যাপার। গায়ে পড়ে উটকো ঝামেলা তোমার ঘাড়ে নেওয়ার দরকার কীসের ?
—বা হ, ভদ্রমহিলার সঙ্গে এত বন্ধুত্ব হয়ে গেল ! অবিরাম গল্প করে গেলে ! আর ট্রেন থেকে নামার সময় সে উটকো ঝামেলা !
নন্দিতা হাতের কাছে ভাল যক্তি খুঁজে পেল না। পেল না বলেই নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল স্পষ্ট ভাবে,—আমি হাওড়া পৌঁছে কারুর জন্য দাঁড়াব না। তুমি অপেক্ষা করে দেখো ওর স্বামী আসে কি না। তারপর দরকার হলে পোঁছে দিয়ে এসো।
শ্যামলেন্দু আরও গম্ভীর হয়ে গেল। গোমড়া মুখে স্যুটকেস হোল্ডঅল নামাচ্ছে বাংক থেকে। মুখ দেখে বোঝা যায় নন্দিতার আচরণে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ সে। শ্যামলেন্দুর কাছে ছোট হয়ে গিয়ে নন্দিতারও খারাপ লাগছিল। কী করবে ? সব মানুষেরই এমন কিছু কথা থাকে যা কাউকে খুলে বলা যায় না। নিজের স্বামী বা স্ত্রীকেও নয় ।
রাকা বাথরুম থেকে মুখ-টুখ ধুয়ে ফিরে এল। নন্দিতারা মোটামুটি নামার জন্য তৈরি। রিমলি ওয়াটার বটল কোলে করে বকবক করছে। সামনের ছেলেমেয়ে দুটোর সঙ্গে।
রাকা নিজের স্যুটকেস মেঝেতে নামাল,
—কাল রাত থেকে আমি একটা কথা ভাবছিলাম।
নন্দিতা জানলা দিয়ে শহরতলির স্কাইলাইন দেখার ভান করছিল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঘুরে তাকাতে হল তাকে,—কী?—কাল আপনি একটা প্রশ্নের উত্তর দ্যাননি কিন্তু।
—কোন প্রশ্ন ? —ওই যে আমি কী ভালবাসি, কী বাসি না ... কাল ওসব কেন জিজ্ঞেস করছিলেন ?
—এমনিই। নন্দিতা লম্বা শ্বাস ফেলল। —স্রেফ কৌতূহল।
—কৌতুহল মিটল ? কী বুঝলেন ?
সব কি আর কোনওদিন পুরোপুরি বোঝা যায় ? সব কৌতুহল মেটে মানুষের ?
নন্দিতা মুখ হাসিহাসি রাখার চেষ্টা। করল, —কিছুটা আন্দাজ পেলাম বৈকি।
রাকা লঘু স্বরে হেসে উঠল,—বেশ । আমার বর স্টেশনে এলে আলাপ করিয়ে দেব। ওর সঙ্গে কথা বললে আরেকটু আন্দাজ বাড়তেও পারে।
মন্থর গতিতে কারশেড পেরিয়ে প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে ডাউনের গাড়ি। নন্দিতার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল।

ট্রেন দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রিমলিকে নিয়ে নন্দিতা আগে ভাগে নেমে পড়েছিল কামরা থেকে। রাকাকে অবাক করে দিয়ে।
শ্যামলেন্দুকে মাল নামাতে একটুও সাহায্য না করে। নেমেই একটা মোটা থামের আড়ালে লুকিয়েছে নিজেকে।
শেষ সন্ধ্যাকালে গোটা স্টেশন চত্বর জুড়ে এখন অফিস ফেরত যাত্রীদের অবিরাম স্রোত। ভরা জোয়ারের মতো। সকলেই ঘরে ফেরার জন্য মরিয়া এখন। নন্দিতার হাঁটু দুটো টিপটিপ কাঁপছিল। অবাধ্য চোখ বারবার ভিড় মাড়িয়ে খুঁজছে অরুণকে। অরুণ এসেছে কি আদৌ। হয়তো এসেছে। হয়তো আর সব কোচগুলোতে উঁকি মেরে খুঁজছে বউকে। মানুষ তো এভাবেই আপন জনকে খুঁজে বেড়ায়।
শ্যামলেন্দুও কুলির মাথায় মাল চাপিয়ে ব্যস্ত চোখে খুঁজছে নন্দিতাকে। নন্দিতা এক দৌড়ে গিয়ে স্বামীর হাত আঁকড়ে ধরল, —তাড়াতাড়ি চলো ।
বলল বটে, তবুও কেন যে বেয়াড়া পা দুটো থেমে পড়তে চাইছে নন্দিতার। ফিরে ফিরে চোখ পিছন দিকেই যায়। এক চিলতে দেখা যদি হতই অরুণের সঙ্গে ক্ষতি কী হত ।। ভাবতে গিয়ে ভাবনা হোঁচট খেয়েছে আচমকা। আশ্চর্য ! একী বোকামি করল সে ! অরুণ যে এই রাকারই স্বামী তাতো না'ও হতে পারে । নন্দিতা একবারও রাকাকে তার স্বামীর নাম জিজ্ঞাসা করেনি ! সম্পূর্ণ ঠিকানাটাও ! পূর্ণ সিনেমার কাছাকাছি দুজন রাকা রায় থাকতেই পারে।
নন্দিতার পা দুটো পুরোপুরি নিশ্চল হয়ে গেল। ফিরে গিয়ে দেখবে !
থাক। যদি সত্যি সত্যি অরুণই হয়। যদি হয়!
ভিড়ের চাপে স্থির হয়ে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। একটা বড় সড় ধাক্কায় কিছুটা পিছিয়ে গিয়েছিল নন্দিতা, আবারও এক ধাক্কায় বুকটা ধক করে উঠেছে। শ্যামলেন্দু বা রিমলি কেউ আর নেই। চোখের নাগালে। দুজনেই ভিড়ে হারিয়ে গেছে।
নন্দিতা উদ্ভ্রান্তের মতো ভিড় সরিয়ে সামনে এগোনোর চেষ্টা করছিল। কোথায় শ্যামলেন্দু ! রিমলি কোথায় ! কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। বড় বেশি উটকো লোক এসে পড়েছে মাঝখানে । হায়রে, নন্দিতা এখন কী যে করে !


                                                                     -----সমাপ্ত-----

আরো গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করবেন
গল্পটির পিডিএফ সংগ্রহ করবেন
পাঠকগণ, 'উজান - সুচিত্রা ভট্টাচার্য' এই  বাংলা রহস্য অণু-উপন্যাসটি পিডিএফ আকারেও সংগ্রহ করতে পারেন।

No comments:

Post a Comment