রামপ্রসাদ: জীবনী ও রচনাসমগ্র বাংলা বই
ডিজিটাল বইয়ের নাম- রামপ্রসাদ: জীবনী ও রচনাসমগ্র
লেখক ও সম্পাদনা - ডা: সত্যনারায়ণ ভট্টাচার্য
বইয়ের ধরন- ধর্ম সম্পর্কিত
ফাইলের ধরন- পিডিএফ
এই বইতে মোট পৃষ্টা আছে- ৩৮৪
ডিজিটাল বইয়ের সাইজ- ২২এমবি
প্রিন্ট ভালো, জলছাপ মুক্ত
‘কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ' সাধক কবি রামপ্রসাদের জীবনী ও রচনার সামগ্রিক আলোচনা। জীবনী রচনার ক্ষেত্রে গ্রন্থে অবলম্বিত পদ্ধতিটি নতুন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত প্রদত্ত বিবরণ অবলম্বন করে কিছু কিছু দলিলপত্র ও সাক্ষিাবুদ ঘেঁটে, কিছুটা বা অলৌকিকতায় আস্থা স্থাপন করে গতানুগতিক জীবনীরচনার যে ধারা প্রচলিত আছে, এ গ্রন্থে সে ধারাটি সম্পূর্ণভাবে বর্জন করা হয়েছে।
বর্তমান গ্রন্থে জীবনী রচনা অপেক্ষা জীবনী আবিষ্কারের চেষ্টা করা হয়েছে বললে আরও পরিষ্কার করে বিষয়টি বলা হয়। এই আবিষ্কারের জন্য অবলম্বিত বিষয় দুটি হল—(১) দেশের সাধারণ ইতিহাস, (২) রামপ্রসাদ রচনা।
শুধু সমসাময়িক কাহিনীর মধ্যে নিবদ্ধ না থেকে দেশের দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে রামপ্রসাদ জীবনীকে স্থাপন করা হয়েছে। হিউয়েন সিয়াঙের সময় থেকে আরম্ভ করে যে সামাজিক ও ধর্মীয় ইতিহাসের ধারা বঙ্গভূমিতে প্রবহমান, বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলমান প্রভাবের মধ্য দিয়ে নানা ভাঙ্গা গড়ায় যে প্রবাহ সর্বদা বাঙালি মননে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার জোয়ার ভাটার সৃষ্টি করে এসেছে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে তা শেষবারের মত মোড় ফিরেছে সম্পূর্ণ অভিনব ভাবে। সেই অভিনব ধারারই সৃষ্টিধর্মী গতিশীলতার প্রকাশ ঘটেছে উনবিংশ শতাব্দীর জাগরণে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই নবচেতনার প্রথম রূপকার কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন। জীর্ণক্ষত পুরাতন ধারা লুপ্ত হয়ে কিভাবে নতুন ধারাস্নান ঘটলো রামপ্রসাদ জীবনী আবিষ্কারে প্রধানতঃ এই ইতিহাসটি তুলে ধরা হয়েছে। সুতরাং কোন অধ্যাত্ম ক্ষমতাসম্পন্ন পুরুষের অলৌকিক মহিমার কীর্তন চিরাচরিত পদ্ধতিতে এ গ্রন্থে করা হয়নি।
ইতিহাসের ফলাফল দেখানোর উদ্দেশ্যে প্রধানভাবে জীবনীরচনায় অবলম্বন করতে হয়েছে কবির রচনাগুলিকে। রামপ্রসাদ রচনার প্রেরণা, রচনার কালক্রম, রচনায় কবির অধিকার প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করতে হয়েছে। এই আলোচনার মধ্য দিয়ে রামপ্রসাদের জীবন ও তার সমসাময়িক কাল কি ভাবে উদঘাটিত হয়েছে গ্রন্থপাঠে তা অবগত হওয়া যাবে।
সঙ্গীত রচয়িতা ও সাধকরূপেই রামপ্রসাদ সাধারণ জনসমক্ষে পরিচিত। তিনি যে 'কালীকীর্তনে'র রচয়িতা ছিলেন, তার খবর অনেকে রাখেন না। আবার তিনি যে ‘বিদ্যাসুন্দর’ রচনা করেন, এ সংবাদটি অনেকের কাছে যেমন অভিনব, তেমনি বিস্ময়কর। এই বিস্ময়ের সূত্রধরেই সম্ভবতঃ ‘পদাবলী’র রামপ্রসাদ ও ‘বিদ্যাসুন্দরে'র রামপ্রসাদকে বিভিন্ন জন ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু উভয় রামপ্রসাদই যে এক এবং 'বিদ্যাসুন্দর’ গ্রন্থেই যে রামপ্রসাদ জীবনীর অধিকাংশ উপকরণ রয়েছে, বর্তমান গ্রন্থে তা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। সাধক রামপ্রসাদের পরিচয় এমন, সুদূরপ্রসারী এবং ভক্ত ও বিশ্বাসীর মনে তা এমনই অলোকসামান্য মহিমায় সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত যে তাঁর ঈশ্বরস্পৃষ্ট সঙ্গীতগুলির সাধারণ সমালোচনার নিরিখে বিচারের কিছুটা অসুবিধা আছেই। খুব সতর্কতার সঙ্গে এই স্পর্শকাতর বিষয়টির অবতারণা করতে হয়েছে। অথচ এই সঙ্গীত রচনার পৰ্যায়বিভাগের দ্বারাই ব্যক্তি রামপ্রসাদের জীবনটিকে তুলে ধরা খুব সহজ। রামপ্রসাদ যখন অভাবের কথা, ব্যক্তিগত নানাবিধ দুর্দশা বা সামাজিক বৈষম্যের কথা বলে মায়ের কাছে অভিযোগ করেন তখন তিনি সাধক হলেও কবি। রামপ্রসাদের প্রথম জীবনের পদ বলে এগুলি গৃহীত হতে পারে।
রামপ্রসাদের পদে তাঁর আধ্যাত্মিক মননের ক্রমোন্নতির ছাপ সুস্পষ্ট। পদে অধ্যাত্মসচেতনতা যতই পরিস্ফুট হয়েছে, পার্থিব সুখসুবিধার উল্লেখ পদ থেকে ততই অপসৃত হয়েছে। মায়ের অলৌকিক রূপের নানা পরিকল্পনায় কবি তখন বিভোর।
এর পরে আর এক জাতীয় অতৃপ্তি ও গ্লানির প্রকাশ ঘটতে আরম্ভ করে। কবির কণ্ঠে মাকে না পাওয়ার জন্য বেদনা সুস্পষ্টভাবে উচ্চারিত। সাধক রামপ্রসাদ এই অতৃপ্তির মধ্যে দিয়ে সাধনার অনেক উচ্চ সোপানে আরূঢ়। কিন্তু সিদ্ধি তখন হয়নি। তখন পর্যন্ত প্রাপ্তির জন্য আকুলতা, অপ্রাপ্তির জন্য ক্রন্দন। সাধক ও কবির মেশামেশি রূপ তখন।
একেবারে শেষ স্তরের পদে সাধকরূপই সুস্পষ্ট। এখানে শুধু মায়েরই জয়গান। মায়ের চরণে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের কথা। মায়ের রূপ উদার সমন্বয়বাদী। কিভাবে সার্থকরূপে সহজে মাকে পাওয়া যায়, তারই নির্দেশ পদগুলিতে।
এই পদগুলি পড়েই অনেকে নির্ধিধায় রামপ্রসাদকে একেশ্বরবাদী, নিরীশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা বিরোধী প্রভৃতি বলে ফেলেছেন। এ প্রসঙ্গে শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব ভট্টাচার্যের “তন্ত্রতত্ত্ব গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগের “বাহ্যপূজা” পরিচ্ছেদটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
রামপ্রসাদের পদে ‘তারা আমার নিরাকারা’, ‘যোগীর কঠিন ভাবা রূপ নিরাকার', ‘ত্রিভুবন যে মায়ের মূর্তি' জাতীয় কথাগুলি পূর্বোক্ত মন্তব্যের কারণ। সাধক শিবচন্দ্র এই মন্তব্যকারীদের সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন-(১) বলিহারি কলিদূতের সিদ্ধান্ত। (পৃ ৪৩৭) (২) তিনি সাকার ব্ৰহ্ম মানিতেন কি না, সাকার উপাসনা করিতেন কি না, মৃত্যুর পূর্ব রাত্রিতেও পূজা করিয়া মৃত্যুকালেও মায়ের মূর্তি সম্মুখে রাখিয়া সিদ্ধ সাধক মহাত্মা তাহার জ্বলন্ত প্রমাণ দেখাইয়া গিয়াছেন। জীবনে ত গানে গানে প্রাণে প্রাণে মূতিমতী মায়ের নৃত্য! ইহার পরেও, রামপ্রসাদের সাকার উপাসনা ছিল না—ইহা যিনি বলিতে পারেন, রামপ্রসাদের আত্মা ছিল না, এ কথাও তাঁহার মুখেই শোভা পায়।' (পৃ ৪৫৬)।
‘মন! তোমার এই ভ্ৰম গেল না—পদে মৃন্ময়ী মূর্তিনির্মাণের অসারতার কথা আছে। এই পদটি সম্বন্ধে সাধক শিবচন্দ্রের অভিমত হল—“উল্লিখিত গানটি যে রামপ্রসাদের অতি অপক্কাবস্থার আমরা ক্রমে তাহার পরিচয় দিতেছি। এখন প্রথমতঃ এইটুকু বুঝিবার কথা যে, যে সময়ে রামপ্রসাদের এই গান সে সময়ে তিনি জ্ঞানরাজ্যের প্রথম স্তর উত্তীর্ণ হইয়া মধ্যন্তরে অবতীর্ণ, শেষ স্তরে অপ্রবিষ্ট এবং সাধনা রাজ্যে নব প্রবিষ্ট মাত্র , তাই ভক্তিতত্ত্বনিরপেক্ষ কেবল জ্ঞানের সহিত সাধনাকে সম্মিলিত করিতে গিয়াই উপক্রম উপসংহার স্থির রাখিতে পারেন নাই।' (পৃ ৪৪৪) বর্তমান গ্রন্থে রামপ্রসাদের পদের বয়ঃক্রম ও সাধনাক্রম অনুসারে স্তরভেদের কথা বলেছি এবং তার সিদ্ধ স্বরূপের পরিচায়ক বলে যে পদগুলির বিবরণ দিয়েছি, সেগুলিতেই রামপ্রসাদের দেবতা ও পূজাপদ্ধতি সম্বন্ধে মতগুলি নিহিত বলে যারা মনে করেন আমরা তাদের সঙ্গেও দ্বিমত নই। শেষোক্ত দলের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হল, আমরা মতগুলি ব্যক্তি করিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেনের মত বলে মনে করি না, আমরা মনে করি এ মত সাধক রামপ্রসাদের সাধনার দ্বারা উপলব্ধ শাশ্বত সত্যবাণী। অনেক সাধনার স্তর অতিক্রম করে সিদ্ধাবস্থায় সাধকের এ সংজ্ঞালাভ হয়।
তবে রামপ্রসাদ উপলব্ধ ‘সংজ্ঞা’র প্রভাবে যদি সাধারণ মানুষের বিচার বুদ্ধি প্রভাবিত হয়, তাহলে তাতে দোষের কিছু দেখি না। সাধনার অন্তে প্রাপ্ত জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান এবং এই জ্ঞানের বলে উচ্চারিত মতগুলিই সর্বজনগ্রাহ্য চিরন্তন মত এবং সাধকেরও প্রকৃত বাণী।
রামপ্রসাদ অনেক সাধনায় যা জেনেছিলেন, বিনা আয়াসে সেইটুকু জেনে যদি কেউ তৃপ্তিলাভ করতে পারেন, তাতে রামপ্রসাদের সাধনারই সার্থকতা প্রতিপাদিত হবে। রামপ্রসাদের পদে অনাড়ম্বর সারল্য ও আন্তরিকতায় বিস্ময় চমকের সঙ্গে এই সত্যগুলি প্রকাশিত হয়ে পাঠকচিত্ত জয় করেছে। এই শ্রেণীর পদের কবিতা হিসেবে এখানেই সার্থকতা এবং পরবর্তী চিন্তাধারা যে এই সত্য ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, তাতেই তাঁর কালজয়ী ক্ষমতার চিহ্ন সুস্পষ্ট। কিন্তু এ আলোচনা এই পর্যন্ত। গ্রন্থে এ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা স্থান পেয়েছে। রামপ্রসাদ জীবনী আবিষ্কারে প্রধান পাথেয় ইতিহাস। - সত্যনারায়ণ ভট্টাচার্য
উপরোক্ত বাংলা বইটির পিডিএফ ফাইল সংগ্রহ করুন অথবা অনলাইনে পড়ুন
প্রিয় পাঠকগণ, এই পোষ্ট হইতে আপনারা 'রামপ্রসাদ: জীবনী ও রচনাসমগ্র' বইটির পিডিএফ সংগ্রহ করিতে পারিবেন।
ডিজিটাল বইয়ের নাম- রামপ্রসাদ: জীবনী ও রচনাসমগ্র
লেখক ও সম্পাদনা - ডা: সত্যনারায়ণ ভট্টাচার্য
বইয়ের ধরন- ধর্ম সম্পর্কিত
ফাইলের ধরন- পিডিএফ
এই বইতে মোট পৃষ্টা আছে- ৩৮৪
ডিজিটাল বইয়ের সাইজ- ২২এমবি
প্রিন্ট ভালো, জলছাপ মুক্ত
‘কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ' সাধক কবি রামপ্রসাদের জীবনী ও রচনার সামগ্রিক আলোচনা। জীবনী রচনার ক্ষেত্রে গ্রন্থে অবলম্বিত পদ্ধতিটি নতুন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত প্রদত্ত বিবরণ অবলম্বন করে কিছু কিছু দলিলপত্র ও সাক্ষিাবুদ ঘেঁটে, কিছুটা বা অলৌকিকতায় আস্থা স্থাপন করে গতানুগতিক জীবনীরচনার যে ধারা প্রচলিত আছে, এ গ্রন্থে সে ধারাটি সম্পূর্ণভাবে বর্জন করা হয়েছে।
বর্তমান গ্রন্থে জীবনী রচনা অপেক্ষা জীবনী আবিষ্কারের চেষ্টা করা হয়েছে বললে আরও পরিষ্কার করে বিষয়টি বলা হয়। এই আবিষ্কারের জন্য অবলম্বিত বিষয় দুটি হল—(১) দেশের সাধারণ ইতিহাস, (২) রামপ্রসাদ রচনা।
শুধু সমসাময়িক কাহিনীর মধ্যে নিবদ্ধ না থেকে দেশের দীর্ঘকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে রামপ্রসাদ জীবনীকে স্থাপন করা হয়েছে। হিউয়েন সিয়াঙের সময় থেকে আরম্ভ করে যে সামাজিক ও ধর্মীয় ইতিহাসের ধারা বঙ্গভূমিতে প্রবহমান, বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলমান প্রভাবের মধ্য দিয়ে নানা ভাঙ্গা গড়ায় যে প্রবাহ সর্বদা বাঙালি মননে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার জোয়ার ভাটার সৃষ্টি করে এসেছে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে তা শেষবারের মত মোড় ফিরেছে সম্পূর্ণ অভিনব ভাবে। সেই অভিনব ধারারই সৃষ্টিধর্মী গতিশীলতার প্রকাশ ঘটেছে উনবিংশ শতাব্দীর জাগরণে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর সেই নবচেতনার প্রথম রূপকার কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন। জীর্ণক্ষত পুরাতন ধারা লুপ্ত হয়ে কিভাবে নতুন ধারাস্নান ঘটলো রামপ্রসাদ জীবনী আবিষ্কারে প্রধানতঃ এই ইতিহাসটি তুলে ধরা হয়েছে। সুতরাং কোন অধ্যাত্ম ক্ষমতাসম্পন্ন পুরুষের অলৌকিক মহিমার কীর্তন চিরাচরিত পদ্ধতিতে এ গ্রন্থে করা হয়নি।
ইতিহাসের ফলাফল দেখানোর উদ্দেশ্যে প্রধানভাবে জীবনীরচনায় অবলম্বন করতে হয়েছে কবির রচনাগুলিকে। রামপ্রসাদ রচনার প্রেরণা, রচনার কালক্রম, রচনায় কবির অধিকার প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করতে হয়েছে। এই আলোচনার মধ্য দিয়ে রামপ্রসাদের জীবন ও তার সমসাময়িক কাল কি ভাবে উদঘাটিত হয়েছে গ্রন্থপাঠে তা অবগত হওয়া যাবে।
সঙ্গীত রচয়িতা ও সাধকরূপেই রামপ্রসাদ সাধারণ জনসমক্ষে পরিচিত। তিনি যে 'কালীকীর্তনে'র রচয়িতা ছিলেন, তার খবর অনেকে রাখেন না। আবার তিনি যে ‘বিদ্যাসুন্দর’ রচনা করেন, এ সংবাদটি অনেকের কাছে যেমন অভিনব, তেমনি বিস্ময়কর। এই বিস্ময়ের সূত্রধরেই সম্ভবতঃ ‘পদাবলী’র রামপ্রসাদ ও ‘বিদ্যাসুন্দরে'র রামপ্রসাদকে বিভিন্ন জন ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু উভয় রামপ্রসাদই যে এক এবং 'বিদ্যাসুন্দর’ গ্রন্থেই যে রামপ্রসাদ জীবনীর অধিকাংশ উপকরণ রয়েছে, বর্তমান গ্রন্থে তা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। সাধক রামপ্রসাদের পরিচয় এমন, সুদূরপ্রসারী এবং ভক্ত ও বিশ্বাসীর মনে তা এমনই অলোকসামান্য মহিমায় সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত যে তাঁর ঈশ্বরস্পৃষ্ট সঙ্গীতগুলির সাধারণ সমালোচনার নিরিখে বিচারের কিছুটা অসুবিধা আছেই। খুব সতর্কতার সঙ্গে এই স্পর্শকাতর বিষয়টির অবতারণা করতে হয়েছে। অথচ এই সঙ্গীত রচনার পৰ্যায়বিভাগের দ্বারাই ব্যক্তি রামপ্রসাদের জীবনটিকে তুলে ধরা খুব সহজ। রামপ্রসাদ যখন অভাবের কথা, ব্যক্তিগত নানাবিধ দুর্দশা বা সামাজিক বৈষম্যের কথা বলে মায়ের কাছে অভিযোগ করেন তখন তিনি সাধক হলেও কবি। রামপ্রসাদের প্রথম জীবনের পদ বলে এগুলি গৃহীত হতে পারে।
রামপ্রসাদের পদে তাঁর আধ্যাত্মিক মননের ক্রমোন্নতির ছাপ সুস্পষ্ট। পদে অধ্যাত্মসচেতনতা যতই পরিস্ফুট হয়েছে, পার্থিব সুখসুবিধার উল্লেখ পদ থেকে ততই অপসৃত হয়েছে। মায়ের অলৌকিক রূপের নানা পরিকল্পনায় কবি তখন বিভোর।
এর পরে আর এক জাতীয় অতৃপ্তি ও গ্লানির প্রকাশ ঘটতে আরম্ভ করে। কবির কণ্ঠে মাকে না পাওয়ার জন্য বেদনা সুস্পষ্টভাবে উচ্চারিত। সাধক রামপ্রসাদ এই অতৃপ্তির মধ্যে দিয়ে সাধনার অনেক উচ্চ সোপানে আরূঢ়। কিন্তু সিদ্ধি তখন হয়নি। তখন পর্যন্ত প্রাপ্তির জন্য আকুলতা, অপ্রাপ্তির জন্য ক্রন্দন। সাধক ও কবির মেশামেশি রূপ তখন।
একেবারে শেষ স্তরের পদে সাধকরূপই সুস্পষ্ট। এখানে শুধু মায়েরই জয়গান। মায়ের চরণে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের কথা। মায়ের রূপ উদার সমন্বয়বাদী। কিভাবে সার্থকরূপে সহজে মাকে পাওয়া যায়, তারই নির্দেশ পদগুলিতে।
এই পদগুলি পড়েই অনেকে নির্ধিধায় রামপ্রসাদকে একেশ্বরবাদী, নিরীশ্বরবাদী, পৌত্তলিকতা বিরোধী প্রভৃতি বলে ফেলেছেন। এ প্রসঙ্গে শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব ভট্টাচার্যের “তন্ত্রতত্ত্ব গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগের “বাহ্যপূজা” পরিচ্ছেদটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
রামপ্রসাদের পদে ‘তারা আমার নিরাকারা’, ‘যোগীর কঠিন ভাবা রূপ নিরাকার', ‘ত্রিভুবন যে মায়ের মূর্তি' জাতীয় কথাগুলি পূর্বোক্ত মন্তব্যের কারণ। সাধক শিবচন্দ্র এই মন্তব্যকারীদের সম্বন্ধে মন্তব্য করেছেন-(১) বলিহারি কলিদূতের সিদ্ধান্ত। (পৃ ৪৩৭) (২) তিনি সাকার ব্ৰহ্ম মানিতেন কি না, সাকার উপাসনা করিতেন কি না, মৃত্যুর পূর্ব রাত্রিতেও পূজা করিয়া মৃত্যুকালেও মায়ের মূর্তি সম্মুখে রাখিয়া সিদ্ধ সাধক মহাত্মা তাহার জ্বলন্ত প্রমাণ দেখাইয়া গিয়াছেন। জীবনে ত গানে গানে প্রাণে প্রাণে মূতিমতী মায়ের নৃত্য! ইহার পরেও, রামপ্রসাদের সাকার উপাসনা ছিল না—ইহা যিনি বলিতে পারেন, রামপ্রসাদের আত্মা ছিল না, এ কথাও তাঁহার মুখেই শোভা পায়।' (পৃ ৪৫৬)।
‘মন! তোমার এই ভ্ৰম গেল না—পদে মৃন্ময়ী মূর্তিনির্মাণের অসারতার কথা আছে। এই পদটি সম্বন্ধে সাধক শিবচন্দ্রের অভিমত হল—“উল্লিখিত গানটি যে রামপ্রসাদের অতি অপক্কাবস্থার আমরা ক্রমে তাহার পরিচয় দিতেছি। এখন প্রথমতঃ এইটুকু বুঝিবার কথা যে, যে সময়ে রামপ্রসাদের এই গান সে সময়ে তিনি জ্ঞানরাজ্যের প্রথম স্তর উত্তীর্ণ হইয়া মধ্যন্তরে অবতীর্ণ, শেষ স্তরে অপ্রবিষ্ট এবং সাধনা রাজ্যে নব প্রবিষ্ট মাত্র , তাই ভক্তিতত্ত্বনিরপেক্ষ কেবল জ্ঞানের সহিত সাধনাকে সম্মিলিত করিতে গিয়াই উপক্রম উপসংহার স্থির রাখিতে পারেন নাই।' (পৃ ৪৪৪) বর্তমান গ্রন্থে রামপ্রসাদের পদের বয়ঃক্রম ও সাধনাক্রম অনুসারে স্তরভেদের কথা বলেছি এবং তার সিদ্ধ স্বরূপের পরিচায়ক বলে যে পদগুলির বিবরণ দিয়েছি, সেগুলিতেই রামপ্রসাদের দেবতা ও পূজাপদ্ধতি সম্বন্ধে মতগুলি নিহিত বলে যারা মনে করেন আমরা তাদের সঙ্গেও দ্বিমত নই। শেষোক্ত দলের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হল, আমরা মতগুলি ব্যক্তি করিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেনের মত বলে মনে করি না, আমরা মনে করি এ মত সাধক রামপ্রসাদের সাধনার দ্বারা উপলব্ধ শাশ্বত সত্যবাণী। অনেক সাধনার স্তর অতিক্রম করে সিদ্ধাবস্থায় সাধকের এ সংজ্ঞালাভ হয়।
তবে রামপ্রসাদ উপলব্ধ ‘সংজ্ঞা’র প্রভাবে যদি সাধারণ মানুষের বিচার বুদ্ধি প্রভাবিত হয়, তাহলে তাতে দোষের কিছু দেখি না। সাধনার অন্তে প্রাপ্ত জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান এবং এই জ্ঞানের বলে উচ্চারিত মতগুলিই সর্বজনগ্রাহ্য চিরন্তন মত এবং সাধকেরও প্রকৃত বাণী।
রামপ্রসাদ অনেক সাধনায় যা জেনেছিলেন, বিনা আয়াসে সেইটুকু জেনে যদি কেউ তৃপ্তিলাভ করতে পারেন, তাতে রামপ্রসাদের সাধনারই সার্থকতা প্রতিপাদিত হবে। রামপ্রসাদের পদে অনাড়ম্বর সারল্য ও আন্তরিকতায় বিস্ময় চমকের সঙ্গে এই সত্যগুলি প্রকাশিত হয়ে পাঠকচিত্ত জয় করেছে। এই শ্রেণীর পদের কবিতা হিসেবে এখানেই সার্থকতা এবং পরবর্তী চিন্তাধারা যে এই সত্য ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, তাতেই তাঁর কালজয়ী ক্ষমতার চিহ্ন সুস্পষ্ট। কিন্তু এ আলোচনা এই পর্যন্ত। গ্রন্থে এ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা স্থান পেয়েছে। রামপ্রসাদ জীবনী আবিষ্কারে প্রধান পাথেয় ইতিহাস। - সত্যনারায়ণ ভট্টাচার্য
উপরোক্ত বাংলা বইটির পিডিএফ ফাইল সংগ্রহ করুন অথবা অনলাইনে পড়ুন
প্রিয় পাঠকগণ, এই পোষ্ট হইতে আপনারা 'রামপ্রসাদ: জীবনী ও রচনাসমগ্র' বইটির পিডিএফ সংগ্রহ করিতে পারিবেন।
No comments:
Post a Comment